সব প্রথমগুলোতেই একটা আলাদা রোমাঞ্চ থাকে, থাকে আলাদা উত্তেজনা। আর, মেরিনারের জন্যে প্রথম জাহাজে যোগ দেওয়াটা যে কত বড় ঘটনা, সেই অনুভূতিটা সহজে বুঝানো যাবে না। এমনিতেই জাহাজ সম্পর্কে সব মানুষের মনেই একটা আলাদা রোমান্টিকতা থাকে; আর আমি এখন এপয়েন্টমেন্ট-লেটার হাতে, ছোটবেলার কাঙ্ক্ষিত সেই স্বপ্ন মেরিনার হওয়ার সাধপূরণের লক্ষ্যে জাহাজের গ্যাংওয়ে দিয়ে উঠে এলাম ‘এম.ভি. বাংলার মিতা’ জাহাজে। আমরা তিনজন একসাথে জয়েন করেছিলাম দুইজন ইঞ্জিন-ক্যাডেট, একজন ডেক-ক্যাডেট।
পাসপোর্টের মতই, সরকারের ইস্যু করা মেরিনারদের থাকে CDC (Continuous Discharge Certificate)। জাহাজে জয়েন করলে, সিডিসি এবং অন্যান্য কাগজপত্র ক্যাপ্টেন-চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে দিতে হয়। এরপরে আমরা দুইজন আমাদের ডাইরেক্ট বস্, সেকেন্ড-ইঞ্জিনিয়ারের কাছে রিপোর্ট করলাম; অন্যদিকে ডেক-ক্যাডেট গেলো তার বস্, চিফ-অফিসারের কাছে। আমার মাথায় ছিলো ইয়া ঝাঁকড়া চুল। আসলে, সেই ক্লাস সেভেন থেকে শুরু করে ক্যাডেট কলেজে এবং পরে মেরিন একাডেমিতে থাকা অবস্থায় কিশোর-যুবকদের আজীবন সাধ ‘লম্বা চুল-রাখা’, সম্ভব হয়নাই। একাডেমি থেকে বের হয়ে, সেই খায়েশটাই মিটাচ্ছিলাম। আমাকে দেখে সেকেন্ড-ইঞ্জিনিয়ারের প্রথম কথা হোয়াট? ইঞ্জিন-ক্যাডেটের মাথায় এত্তো বড় চুল? যাও ইঞ্জিনরুমে ডিউটি করতে যাও, ডিউটি শেষে সেলুনে গিয়ে চুল কেটে সেই চুলের ওজন মেপে আসবে। যতটুকু ওজন, ঠিক তত ঘন্টা এক্সট্রা-ডিউটি। নাহ্, সেই সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন আসলে খুবই ভালো মানুষ। ওনার আন্ডারে থেকেই আমরা দুই ক্যাডেট অনেক কিছু শিখেছিলাম।
আসলে বাংলার মিতার সব অফিসারই ছিলেন খুব ভালো, আমরা বলি ‘গুড ক্রাউড’। অধিকাংশই একাডেমির সিনিয়াররা – খুবই সুন্দর সময় কেটেছিলো। প্রথম জয়েন করার পরে কয়েকদিন একটু বেশী বেশীই কাজ করতে হয়। দুনিয়ার অধিকাংশ প্রফেশানের মতই, বই-খাতার বিদ্যার সঙ্গে আসল কাজের ক্ষেত্রে হাতে-কলমে অনেক তফাৎ। এখানেও এত্তকিছু নতুন নতুন জিনিসের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি যে, মাথা ঘুরিয়ে যায়। বইয়ে ইঞ্জিনের ছবি দেখে একটা ধারণা জন্মেছিলো; কিন্তু সেই ইঞ্জিন যে এত্তবড় সেটা কল্পনাই করি নাই। চার-পাঁচ তলার সমান ইঞ্জিন! আর কি আওয়াজ বুম,বুম,বুম। ইঞ্জিন-বয়লার-জেনারেটর, পাম্প, পিউরিফায়ার, তেল-পানির লাইন, এয়ার কমেপ্রসার কতকিছু। সিনিয়াররা চিনিয়ে-বুঝিয়ে-শিখিয়ে দিচ্ছেন। তারপরেও তালগোল পাকিয়ে ফেলি।
সুইডেনে ১৯৬৬ সালে Hokkaido নাম নিয়ে এই জাহাজের জীবন শুরু করে। পরে কোন একসময়ে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশান এটার মালিকানা পায়, নামকরণ হয় ‘বাংলার মিতা’। জেনারেল-কার্গো জাহাজ হিসাবে বিভিন্ন দেশ থেকে নানান জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করতো। আমি ১৯৮৫ সালের কথা বলছি। সেসময়ে শিপিং কর্পোরেশানে কিছু জাহাজ ছিলো ফরেন-গোয়িং(FG); আর কিছু ছিলো লাইটারিং (আউটার-এঙ্কোরেজে গিয়ে বড়-বড় জাহাজ থেকে মাল-খালাস করে পোর্টে আনতো)। মিতা ছিলো ফরেন-গোয়িং; আমাদের জয়েনের আগেরদিনই মাত্র ফার-ইস্ট থেকে এসেছে।
চট্টগ্রামে আসার পরে অনেক অফিসার-ক্রু চেঞ্জ হলো, জাহাজী ভাষায় ‘সাইন-অন/সাইন-অফ।’ আমরা নতুনরা সাইন-অন করে যোগ দিলাম। যতই অদল-বদল হোক না কেন, জাহাজের কাজকর্ম কিন্তু থেমে নাই। কার্গো লোডিং-আনলোডিং চলছে; ইঞ্জিনরুমে মেইন্টেন্যান্সের কাজ চলছে, খাওয়ার-দাওয়ার (প্রভিশান) উঠানো হচ্ছে। প্রতিটা মুহূর্তই ব্যস্ততার মাঝে কাটে। দুদিনের মাথায় রওনা দিলাম মংলার উদ্দেশ্যে। সেটাই আমার প্রথম সমুদ্রযাত্রা। জাহাজে ক্যাপ্টেন আর চিফ-ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া সকলে ওয়াচ দেয় ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসাররা ইঞ্জিনরুমে, আর নেভিগেশানাল অফিসাররা ব্রিজে। চারঘন্টা ওয়াচ, আটঘন্টা বিশ্রাম আমরা বলি ফোর-অন/এইট-অফ। ওয়াচ কখনই একা দেওয়া যাবে না; নিজের নিরাপত্তার জন্যে কমপক্ষে অফিসারের সঙ্গে একজন ক্রু (বা রেইটিং) থাকতেই হবে। সকাল আটটা-বারোটা এক টিম ওয়াচ করে, আটঘন্টা ছুটি। বারোটায় যেই টিম আসবে, তারা বিকাল চারটায় শেষ করবে। এরপরের টিম চারটা থেকে রাত আটটা। আবারো রাত আটটায় আসবে সকালের প্রথম টিমটা। এইভাবেই সাইকেল চলতে থাকে। বিশ্রামের আটঘন্টায়ও মাঝে মাঝে অন্যান্য কাজ করতে হয়; বিশেষ করে সেকেন্ড-ইঞ্জিনিয়ারকে ও চিফ-অফিসারকে ওনারা সঙ্গে রাখেন ক্যাডেটদের। নতুন জাহাজগুলোতে, উন্নত টেকনোলোজির কারণে ইঞ্জিনরুমে অবশ্য চব্বিশ ঘন্টাই থাকতে হয়না – UMS (Unattended Machinery Space)। ইঞ্জিনিয়াররা সারাদিন কাজকর্ম করে বিকালে এলার্ম-সেট করে চলে আসে। কোন গন্ডগোল হলে এলার্ম আসবে, এবং দ্রুত নীচে গিয়ে ঠিক করতে হবে।
তবে বাংলার মিতা পুরানো আমলের জাহাজ, সেটার ইঞ্জিনরুমে সবসময়ই থাকতে হতো। সমুদ্রে জাহাজের ইঞ্জিন চব্বিশঘন্টাই চলছে, সেই সঙ্গে চলছে কারেন্টের জন্যে জেনারেটার, আনুষাঙ্গিক অন্যান্য যন্ত্রপাতি-পাম্প ইত্যাদি। আমরা সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখতাম প্রেশার-টেম্পারেচার রেকর্ড করতাম। একটু গড়মিল দেখলে ঠিকঠাক করে দিতাম। যেই মেশিনগুলো বন্ধ, সেগুলোকে সার্ভিসিং করে রেডি রাখতাম। অল্প-অল্প করে কাজ শিখলাম।
মংলায় দুইদিন থেকে, চট্টগ্রামে ফিরে দুইদিন পরে মালোয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মালোয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর, সাউথ-কোরিয়া তারপরে জাপানের অনেকগুলো বন্দরে ঘুরে আবারো সিংগাপুর হয়ে চট্টগ্রামে ফেরত। সেটাই ছিলো আমার প্রথম জাহাজ, প্রথম ভয়েজ।
‘বাংলার মিতা’-র বেশ কয়েকটা ঘটনা এখনো মনে আছে। প্রথমত, আমরা তিন নতুন ক্যাডেট আমাদের চুল হারিয়েছিলাম। শুরুতেই বলেছিলাম, কীভাবে জয়েনিং-এর প্রথমদিন সেকেন্ড-ইঞ্জিনিয়ার আমার বিশাল ঝাঁকড়া-চুল দেখে এক্সট্রা-ডিউটি দিয়েছিলেন। কিন্তু ভয়েজে যাওয়ার পরে, মেরিনারদের একটা ট্র্যাডিশান অনুযায়ী আমরা তিনজনই পুরা বেলমাথা হয়ে গেলাম। ট্র্যাডিশানটার ব্যাপারে পরে লিখবো। দ্বিতীয় ঘটনাটা আমার বন্ধুকে নিয়ে। জাহাজের প্রথম কয়েকমাসের অতিরিক্ত কাজের চাপে সে বেচারা ক্লান্ত। আটঘন্টা রেগুলার ডিউটির পরেও আরো বেশ কয়েকঘন্টা এক্সট্রা করতে হয়। জাহাজ চট্টগ্রাম পোর্টে, রাত তখন বারোটা/একটা হবে। আমার বন্ধু নতুন-ক্যাডেট, আর একজন সিনিয়র-ক্যাডেট ডিউটিতে। সিনিয়রজন, তাকে ইঞ্জিনরুমে রেখে, কেবিনে গিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। আর আমার বন্ধুও বেশ কিছুক্ষণ কাজকর্ম করে, ক্লান্ত হয়ে সেখানের কন্ট্রোলরুমের এসিতে ঘুমিয়ে পড়লো। এর মাঝে হঠাৎ করে চিফ-ইঞ্জিনিয়ার সারপ্রাইজ-ভিজিটে ইঞ্জিনরুমে এসে তাকে হাতেনাতে ধরে ফেললেন। আর যায় কই। বকাঝকার পালা শেষ করে, তাকে ইঞ্জিনের ব্যাপারে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করায়, সে উত্তর দিলো আমি তো মাত্র দুদিন হলো জয়েন করেছি, আমি কিছুই জানি না। চিফ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে তুমি একা একা ইঞ্জিনরুমের ইনচার্জ হলে কী করে? তার সরল উত্তর, ইনচার্জ তো সিনিয়র-ক্যাডেট। তো সে কই? সে তো কেবিনে ঘুমাচ্ছে। এইবারে আর চিফের রাগ ধরে রাখা যায় না। দুইজনকেই এক্সট্রার উপরে এক্সট্রা-ডিউটি করতে হয়েছিলো সেইবার।
শেষের ঘটনাটা ঘটিয়েছিলাম আমিই। জাহাজ তখন মাঝসমুদ্রে। রাত আটটা-বারোটার ডিউটিতে আমি থার্ড ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। অন্যরা সবাই ডিনার শেষ করে, স্মোকরুমে (কমনরুমে) আড্ডা, ভিডিও, তাস/দাবা/স্ক্র্যাবল ইত্যাদিতে সময় কাটাচ্ছে। আমি ইঞ্জিনরুমে ঘুরতে ঘুরতে, হঠাৎ দেখি একটা জেনারেটর থেকে অল্প অল্প আগুনের হল্কা বের হচ্ছে। দৌড় দিয়ে কন্ট্রোলরুমে গিয়ে থার্ড ইঞ্জিনিয়ারকে বললাম যে দুই-নাম্বার জেনারেটরে আগুনের স্পার্ক দেখছি। উনি ইমার্জেন্সিতে বললেন অন্য জেনারেটর চালাও, দুই নাম্বারটাকে বন্ধ করতে হবে। নতুন ক্যাডেট আমি, সব কাজ তখনো ভালমত রপ্ত করতে পারিনাই; তার উপরে একটা ইমার্জেন্সির উত্তেজনায় ছিলাম। আমি আরেকটা জেনারেটর চালিয়ে, সঙ্গে সঙ্গেই দুই নাম্বারটা বন্ধ করে দিয়েছি সেটাই হলো চরম ভুল। জেনারেটরগুলো জাহাজে ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই দেয়, সেগুলো শুধু চালালেই হবে না। ইলেক্ট্রিক্যাল লাইনে সিনক্রোনাইজ করে, লোড দিয়ে ইলেক্ট্রিক্যালি বাস্বার (বা গ্রীডের) সঙ্গে কানেক্ট করতে হবে। আমি উত্তেজনা ও তাড়াহুড়ায় সেই কথা ভুলে গিয়েছিলাম, তাই একটা চালিয়েই অন্যটা বন্ধ করে দিয়েছি, ইলেক্ট্রিক্যাল লোড- শেয়ারিং ছাড়াই। ব্যাস আর যায় কই? সারা জাহাজের ইলেক্ট্রিক্যাল সিস্টেমে কারেন্ট শর্ট, চারিদিকের লাইট নিভে যাচ্ছে, ইমার্জেন্সি জেনারেটর স্টার্ট নিয়ে নিয়েছে, সারা জাহাজে এলার্ম বাজছে। উপর থেকে খেলা-সিনেমা বাদ সিয়ে সকলে দৌড়ে চলে এসেছে ইঞ্জিনরুমে। নিরীহ-গোবেচারা, কিন্তু কালপ্রিট আমি, কন্ট্রোলরুমে ঢুকেই সকলের মৌখিক-আক্রমণের সম্মুখীন। আমার তো তখন ‘ধরনী দ্বিধা হও’ অবস্থা। কিন্তু সমুদ্রের মাঝে ধরণী কিভাবে দ্বিভাগ হবে? (মুসা-নবীর দরকার)। যাহোক, সকলে আসায় সুবিধাই হয়েছে। দুই তিনমিনিটেই ঠিকঠাক করে আবার সব নর্মাল করে ফেলা গেছে। আর এই কান্ডের হোতা আমি, চিফ-ইঞ্জিনিয়ার থেকে এক্সট্রা দুই ঘন্টার ডিউটি উপহার পেয়ে গেলাম। তাও ভালো যে, জাহাজে বড়সড় কোন বিপদ ঘটে নাই।
ইন্টারনেট ঘেঁটে একটা তথ্য পেলাম যে, ১৯৯১ সালে বাংলার মিতা জাহাজটাকে চট্টগ্রামে স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। মনে মনে চিন্তা করলাম, সেই ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত কতশত নাবিক এই জাহাজে সেইল করেছে। তাদের সকলেরই সুখ-দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এর প্রতিটা ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। সেগুলোও ধীরে ধীরে মুছে যাবে কালের স্রোতে। আমার একটা অনুরোধ কারো যদি কোনো বিষয়ে কোনো কৌতূহল থাকে, তাহলে আমাকে refayet@yahoo.com ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
টলিডো, ওহাইও, ২০২২
আমি ইঞ্জিনরুমে ঘুরতে ঘুরতে, হঠাৎ দেখি একটা জেনারেটর থেকে অল্প অল্প আগুনের হল্কা বের হচ্ছে। দৌড় দিয়ে কন্ট্রোলরুমে গিয়ে থার্ড
ইঞ্জিনিয়ারকে বললাম যে দুই-নাম্বার জেনারেটরে আগুনের স্পার্ক দেখছি। উনি ইমার্জেন্সিতে বললেন অন্য জেনারেটর চালাও, দুই নাম্বারটাকে বন্ধ করতে হবে। নতুন ক্যাডেট আমি, সব কাজ তখনো ভালমত রপ্ত করতে পারিনাই; তার উপরে একটা ইমার্জেন্সির উত্তেজনায় ছিলাম। আমি আরেকটা জেনারেটর চালিয়ে, সঙ্গে সঙ্গেই দুই নাম্বারটা বন্ধ করে দিয়েছি সেটাই হলো চরম ভুল।