‘প্রত্যেক বিচ্ছেদে মৃত্যুর ছায়া থাকে’

প্রফেসর ডা. প্রবীর কুমার দাশ | বুধবার , ১৪ জুলাই, ২০২১ at ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ

ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত ইংলিশ উপন্যাসিক জর্জ ইলিয়ট (মেরী এ্যান উইলিয়াম) বলেছেন, In every parting there is an image of death (প্রত্যেক বিদায়ে মৃত্যুর প্রতিবিম্ব রয়েছে)। অর্থাৎ ক্ষণিকের বিদায় চিরবিদায়ের প্রতিচ্ছবি। পৃথিবীতে মানুষের আগমনের সাথে সাথে বহির্গমন বা বিদায় ও স্থির হয়ে যায়। বিভিন্ন মুহূর্তের ক্ষণিকের বিদায়ের মাধ্যমে মানুষের চির বিদায়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বিদায় অবধারিত, চিরন্তন জেনেও তা মেনে নেয়া মানুষ কিংবা প্রকৃতির স্বভাবসিদ্ধ নয়, তাই সকলে বিদায়কে অস্বীকার করতে চায়। কবিগুরু তাঁর সোনার তরী কাব্যে ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় লিখেছেন, ‘এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমত্য ছেয়ে/ সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে গভীর ক্রন্দন- যেতে নাহি দিব হয়ে তবু যেতে দিতে হয় তবু চলে যায় চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে।’ এই ‘যেতে নাহি দিব’ এর কারণে বিদায় ব্যথা করুণ হয়ে বাজে।
আমার বাল্যকাল কেটেছে গ্রামীণ পরিবেশে। গ্রামের মাঠ, ঘাট, প্রান্তর, গাছপালা সবকিছুর সাথে জড়িয়ে আছে আমার স্মৃতি। এই রকম অনেক বাল্যস্মৃতি আমাকে এখনও তাড়িত করে। তা ফিরে পেতে মন ব্যাকুল হয়। কিন্তু তা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। অনেক স্মৃতি বিজড়িত স্থান রয়েছে; অনেক আবেক তার সাথে জড়িয়ে আছে সেই সব স্থানে হয়ত এ জীবনে আর যাওয়া হবে না। সে স্থান থেকে আমার চিরবিদায় গ্রহণ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। শৈশব ও কৈশোরের অপরিনত বয়সে অনেক দিন যাবৎ এই বিশ্বাস আমার মধ্যে দৃঢ়ভাবে কাজ করছে যে এই ছোট জীবনে যা নিশ্চিত করে ও একান্তভাবে পাওয়া গেছে তার কিছুই হারাবার নয়। এই ঘরবাড়ি, মাঠ, ঘাট, প্রান্তর, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবকিছুই। অর্থাৎ বিদায় বিচ্ছেদের কোন বিষয় এখানে নেই। শৈশবে প্রথম বিদায় বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে আমার ছোট কাকার অকাল মৃত্যুতে। আমাকে বাড়িতে রেখে অন্যরা মরদেহ সৎকারে তাকে মহাশ্মশানে নিয়ে গেলেও আমার তা বিশ্বাস হয়নি। পরে আস্তে আস্তে অনুধাবন করি যে কাকা সত্যিই চিরবিদায় নিয়েছেন। এটাই আমার জীবনে প্রথম প্রিয়জন হারানোর বিদায় বেদনা। নিজে প্রথম আনুষ্ঠানিক বিদায় গ্রহণ করি স্কুল থেকে। তার পর কলেজ জীবন শেষে ডাক্তারি পড়াতে দীর্ঘ সময় ঢাকায় অবস্থান করি। ঢাকা থাকাকালীন মামা বাড়ির দাদু, দিদিমার মৃত্যু সংবাদ পাই। দূরে অবস্থানহেতু তাদের অস্তিম সময়ে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়নি। চাকরি জীবনে ঘনঘন কর্মক্ষেত্র পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক ফিজিশিয়ান (আরপি) পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণের সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন করে। আমি তখন বগুড়া মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে বদলি হই। পরবর্তীতে কুমিল্লা, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম, কঙবাজার মেডিকেল কলেজে দায়িত্ব পালন করি বিভিন্ন মেয়াদে। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে চাকরিরত অবস্থায় ২০০৬ সালে আমার পিতা প্রস্টেট অপারেশনের জটিলতা নিয়ে চট্টগ্রামের একটি ক্লিনিকে ভর্তি অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমি বাবার অন্তিম সময়ে শয্যা পাশে বসে থেকে তার চিরবিদায় প্রত্যক্ষ করি। মৃত্যুর দিন মধ্যরাত থেকে অবস্থার ক্রমাবনতির এক পর্যায়ে ভোর রাতে তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ লাভ করেন। চাকরি জীবনে নিজে বিভিন্ন কর্মস্থল থেকে বিদায় গ্রহণ ছাড়াও বিভিন্ন সহকর্মীর বিদায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছি। বিদায়ী ব্যক্তি দুঃখভারাক্রান্ত মনে বিদায় গ্রহণ করেন। তিনি তার কর্মক্ষেত্রের অক্ষমতার কথা অকপটে স্বীকার করেন। অনুষ্ঠানের আয়োজকগণ বিদায়ী ব্যক্তির কর্মক্ষেত্রের অবদান তুলে ধরেন সশ্রদ্ধ চিত্তে। বস্তুত ব্যক্তি পর্যায়ে কারো পক্ষেই তার সক্ষমতার সবটুকু প্রয়োগ সম্ভব হয় না। বিভিন্ন অক্ষমতা ও অপূর্ণতা নিয়েই সবাইকে বিদায় গ্রহণ করতে হয়। হাসিমুখে বিদায় গ্রহণ প্রায় ক্ষেত্রেই হয়ে উঠে না। সবাই কমবেশী আবেক তাড়িত হয়ে পড়েন বিদায় মুহূর্তে । অনেকে অশ্রুসজল হন। অঝোর ধারায় কান্না করতেও দেখা যায় কাউকে। তার অন্তর্নিহিত কারণ হয়ত জর্জ ইলিয়টের সেই বচন ‘প্রত্যেক বিচ্ছেদে মৃত্যুর ছায়া থাকে। ’
কর্মক্ষেত্র থেকে আমার বিদায় গত ২০২১ সালের ৩০ জুন। ১৯৯১ সালের ২৬ জানুয়ারি আমার চাকরি জীবনের শুরু। এই দীর্ঘ ৩০ বছর ৫ মাস ৪ দিনের চাকরি জীবনে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাঠ,ঘাট প্রান্তর দেখার সুযোগ পেয়েছি। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ হয়েছে। কর্মক্ষেত্রের অনুরাগী জন সাধারণ ও ছাত্রছাত্রীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছি। সর্বশেষ কর্মস্থলে কর্তব্য পালনকালে সামর্থ্যের সবটুকু দেয়ার চেষ্টা করেছি। তবে অনেক করণীয় অসমাপ্ত পড়ে রয়েছে। সময়ের সাথে পেড়ে উঠতে সম্ভব হয়নি। কিছু লেখালেখি করেছি। বই, বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা, পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেছি। সমাজ সেবায় অবদান রাখতে সচেষ্ট থেকেছি। কিন্তু বিদায় বেলায় আমার উপলব্ধি আমার ক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগাতে পারিনি। চলার পথে আপামর মানুষের যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি তার প্রতিদান হিসাবে তা সামান্যই।
প্রতিটি মানব সন্তানই অনেক সম্ভাবনা ও অন্তর্নিহিত শক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তবে অনেকের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে এই শক্তির বিকাশ ঘটে না। অনেকে তার অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয় না। এই শক্তি স্থিতিশক্তি হিসাবে রয়ে যায়। তা কাজে অর্থাৎ গতিশক্তিতে পরিণতি লাভ করে না। বড় হয়ে সক্ষমতা লাভের বিশাল ব্রত নিয়ে পৃথিবীতে মানুষের আগমন। আমিও অনেক বড় হবার অন্তর্নিহিত শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আসি। আমি বড় ডাক্তার হবো, বড় শিক্ষক হবো, বড় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হবো, বড় সমাজ সেবক হবো .. ……. ইত্যাদি আরো কত কি? বড় হবার বহুমুখী চেষ্টাও চলল সারা জীবন। প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্যে কেটেছে আমার ছোটবেলা। অকৃত্রিম গ্রামীণ বাঙালি জীবন উপভোগ করেছি। কলেজ জীবনে এসে শহুরে জীবনের সাথে পরিচয় শুরু। ছাত্রজীবনে ভালো ফলাফল করেছি কিন্তু তা প্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি সক্ষম হয়নি। পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলাকে সঙ্গী করেছি। সাক্ষী হয়েছি বাংলাদেশের রক্তাক্ত অভ্যূদয়ের । কিন্তু অপরিণত বয়সের কারণে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণে সক্ষম হয়নি। ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছি। কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছি। তবে পরবর্তীতে পেশাগত কিংবা জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি। আমি আমাদের গ্রামের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি। ছিলাম নাট্য দলের সদস্য। সঙ্গীত চর্চায় সচেষ্ট ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা স্কুলের প্রাতঃকালীন জাতীয় সংগীত পরিবেশনেই সীমাবদ্ধ থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ডিগ্রিধারী হয়ে বিসিএস এর মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করি। বাংলাদেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল আমার কর্মস্থল। একই কর্মস্থলে বেশি দিন দায়িত্ব পালন হয়ে উঠেনি। বিভিন্নভাবে তা ব্যাহত হয়। চাকুরীতে বারো বার বদলী হয়ে সর্বমোট তেরটি কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করি। দুর্গম পল্লী, পার্বত্য অঞ্চল, হাওড় এলাকা, মেডিকেল কলেজ, পোস্ট গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউট সর্বত্রই দায়িত্ব পালন করেছি। কর্মস্থলের মধ্যে আছে সাতটি মেডিকেল কলেজ, ২টা পোস্ট গ্রাজুয়েট ইনষ্টিটিউট এবং ৩টা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র। এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক থেকে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক হিসাবে সক্ষমতার সবটুকু প্রদর্শন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। করণীয় যা কিছু ছিল তার অনেকটাই অসমাপ্ত রয়ে গেছে। চাকরি জীবনে ঘুরেছি এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার অনেক দেশ। ঘুরেছি ভারত, সিঙ্গাপুর, জাপান, আমেরিকা, কানাডা, ইতালী, সুইজারল্যান্ড, জার্মানী, ফ্রান্স, লন্ডন। কিন্তু আমার নিজের দেশেই রয়ে গেছে অনেক কিছু দেখার বাকি। বাংলাদেশের অনেক দর্শনীয় স্থান এখনও দেখা হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে দেখার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সব মিলিয়ে অপূর্ণতা যথেষ্ট, অক্ষমতা সীমাহীন। চাকরি জীবনের শেষ দিকে মহামারী করোনার থাবায় অন্যান্যদের মতো আমরাও পেশাগত জীবন বাধাগ্রস্ত হয়। চলমান মহামারীর মধ্যে চাকরি জীবনের পরিসমাপ্তি। এই পস্থিতিতে আমার সহকর্মীগণ বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, বিভিন্ন বিভাগের প্রধানগণ, হৃদরোগ বিভাগের সর্বস্তরের চিকিৎসক, নার্সিং অফিসার ও কর্মচারীরা আমাকে বিদায় সম্ভাষণ জ্ঞাপন করেন। তারা আমার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কিন্তু আমার নিজস্ব উপলব্ধি হল মহান সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত অমিত শক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার আমার পক্ষে হয়ে উঠেনি। তাই কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় আমিও বলি, ‘বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তি দাতা।’ শক্তিমানের এই অক্ষমতা!
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ