প্রতিটি চা-পাতায় লুকিয়ে থাকে চা-শ্রমিকদের আর্তনাদ

করবী চৌধুরী

| বৃহস্পতিবার , ২৫ আগস্ট, ২০২২ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

‘চা’। সুদূর চীন দেশ থেকে আগত এই পানীয়টার কথা মনে হলেই আমাদের মনজুড়ে খেলা করে ক্লান্তিনাশা এক চনমনে ভাব। আমাদের অনেকের কাছেই চা এর অপর নাম হলো রিফ্রেশমেন্ট। নানাধরণের সুগন্ধিযুক্ত, হরেক নামের, হরেক ব্র্যান্ডের নামীদামি চা পান করি আমরা প্রতিদিন।
চায়ের প্রতিটা চুমুক, যা আমাদের সকল ক্লান্তি দূর করে ভাবনায় নিয়ে যায় এক অমরাবতীতে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অব্যবস্থা আর মালিকপক্ষের বৈরীতার ফলে সেই চা শ্রমিকদের অস্তিত্বটাই আজ হুমকির মুখে। একান্তই অপারগ হয়ে বেঁচে থাকার স্বার্থে আজ তারা আন্দোলনে নেমেছে। বর্তমান দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার লক্ষ্যে সিলেটের মোট ১৪১টি চা-বাগানের শ্রমিকেরা একত্রে সংগ্রামরত আজ। ‘বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন’ এর কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসাবে এই কর্মসূচি পালন করছেন তারা। বর্তমানে মালিকপক্ষ মাত্র ২৫ টাকা বাড়িয়ে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৪৫ টাকা করার ঘোষণা দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরো ৫ টাকা বাড়িয়ে ১৫০ টাকা দৈনিক মজুরি করার জন্য মালিকদের অনুরোধ করেছেন।
আগস্ট মাস শোকের মাস বিধায় শ্রমিকরা সাময়িকভাবে ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেও দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবী পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের এই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রশ্ন হলো, তাদের কেন এই আন্দোলনে নামতে হলো? সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই নিরীহ এই চা-শ্রমিক সমপ্রদায় শ্রমশোষণের শিকার হয়ে আসছে। সারাদিন কাজ করে একজন শ্রমিকের আয় মাত্র ১২০ টাকা! লাগামহীন ভাবে সকল দ্রব্যমূল্য বাড়লেও বাড়ে না তাদের আয়। তাদের নেই কোন নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক জাতিগত পরিচয়। কাজ করতে গিয়ে অঙ্গহানি কিংবা মৃত্যু ঘটলেও নেই কোন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা। এই কিছুদিন আগেই শ্রীমঙ্গলে টিলা ধসে চারজন নারী চা- শ্রমিকের মৃত্যু হলো, বাসস্থানের জন্য সুড়ঙ্গ খুঁড়তে হলো আরও কয়েকজনের মৃত্যু, এভাবে জীবন বিসর্জন তাদের নৈমিত্তিক ঘটনা। কে আর তাদের খবর রাখে?
হতদরিদ্র এই মানুষগুলো দু’বেলা দু’মুঠো আহারের জন্য রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে, পেটে খিদে নিয়ে খালি পায়ে জোঁক, মশা, বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ ইত্যাদির কামড়ে ভীত না হয়ে, মুখ বুজেই উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলে। চা-বাগানের মাঝেই ৭ফুট বাই ১৪ ফুট ঘরে পরিবার পরিজনের পাশাপাশি গবাদিপশুসহ মানবেতর বসবাস তাদের। ঘরের মধ্যে থেকেও ঝড়বৃষ্টিতে ভিজতে হয় তাদের। বাগান কর্তৃপক্ষ ঘর মেরামত করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। শুধু বাসস্থানই নয়, এখানে বিশুদ্ধ পানীয়জলেরও রয়েছে দারুণ অভাব! একঘড়া জলের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাদের। নিজেদের শ্রম আর ঘামে উৎপাদিত চা একটুখানি দুধ-চিনি দিয়ে খাওয়ার সামর্থটুকুও নেই তাদের। রোজ সকালে লবণ দিয়ে একমগ চা আর চালভাজা খেয়ে দিনের শুরু তাদের। সারাদিন দুপায়ে দাঁড়িয়ে, মাইল হেঁটে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।
আসলে চা-বাগানের শ্রমিকদের জীবনটাও যেন চা-গাছের মত একটা নির্দিষ্ট সীমারেখায় বন্দী। কোনোভাবেই যেন মাথা উঁচু করে জীবনের পথে দাঁড়াতে না পারে, সেভাবেই যেন নিয়মনীতি করে গড়ে তোলা হয়েছে তাদের!
চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পরিকাঠামোর অভাবে দিনের পর দিন রোগাক্রান্ত হয়ে থাকে তারা। দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা তাদের জীবনযাত্রার পরিবেশকে করে তোলে পুঁতিগন্ধময়। সন্তানদের লেখাপড়া করানোর ইচ্ছে থাকলেও অপ্রতুল শিক্ষাসামগ্রীর জন্য তা আর হয়ে ওঠে না।
চা-বাগানগুলোর শ্রমিকদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নারী। তাদের অবস্থা আরোও সঙ্গিন! মাতৃত্বকালীন সময়েও খুব একটা ছুটি তারা পায়না। সুশিক্ষিত কোনো ধাত্রী নেই এখানে। প্রসব পরবর্তী জটিলতায় চিকিৎসা অপ্রতুলতার জন্য এখানকার নারী শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত ম্যালেরিয়া, কৃমি, যক্ষা, কুষ্ঠ, চর্মরোগ ইত্যাদিতে ভোগেন।
বৈষম্যের গ্যাঁড়াকলে পড়ে তাদের নিয়তি সর্বদাই ভাগ্যচক্রের কাছে মার খেয়ে চলেছে।
অথচ পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে চরম বৈষম্যের শিকার এই অসহায় চা-শ্রমিকেরাও কিন্ত আমাদের মত রাষ্ট্রের কাছে মৌলিক অধিকারের সমান দাবীদার।
১৮৩০ এর দশকে সুন্দর জীবনযাত্রার লোভ দেখিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ১১৬ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে চা- বাগানের শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছিলো, ‘গাছ নাড়লেই টাকা ঝরবে’ এইলোভ দেখিয়ে। কিন্তু গাছ নাড়লে টাকা পাওয়া তো দূরের কথা, পাহাড়- জঙ্গলময় পরিবেশে হিংস্র জীবজন্তুর বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে, অনাহারে- অর্ধাহারে, অসুখ-বিসুখকে নিত্য সাথী করে এক বীভৎস জীবনের সম্মুখীন এখন তারা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নির্জীব এক শ্রেণিতে রূপান্তরিতও বটে!
চা-বাগানের ছায়াঘেরা ভাণ্ডারের অকৃত্রিম মায়া আর অপার হাসি দেখে আমরা মুগ্ধ হই, কিন্তু দেখতে পাই না কেবল সেখানে লুকিয়ে থাকা শ্রমিকদের কান্নার আর্তনাদ আর আহাজারি! এই চুড়ান্ত আধুনিক বিশ্বে সবুজঘেরা বিস্তৃত প্রান্তরে কিভাবে এক বর্বরোচিত জীবন পরিচালিত করছে এসব শ্রমিকরা, বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা! ভাবা যায়!
অথচ শ্রমিকদের শ্রম শোষণ করে চা-পাতা বিক্রি করে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে এই চা-বাগানের মালিকগুলো। দেশে শীর্ষ ধনীর তালিকায় আছে তাদের নাম। প্রতি বছর কয়েক কোটি কেজি চাপাতা দেশে-বিদেশে বিক্রি হয়, এবছরও প্রায় সাড়ে নয় কোটি কেজি চা পাতা বিক্রি হয়েছে। কিন্তু যাদের জন্য এটা সম্ভব হচ্ছে, তাদের প্রতি বিমুখতা যেন চরমে! মালিকপক্ষ মানুষ হিসেবেই যেন গণ্য করতে চায়না তাদের! দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার লক্ষ্যে আজ তাদের এই যে আন্দোলন, সেটা তো দ্রব্যমূল্যের এই উর্ধ্বগতির বাজারে ন্যূনতমই বলা যায়! আমি বলবো, চা- শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকায় উন্নীত করার পাশাপাশি তাদের সামাজিক সুরক্ষা, বিশুদ্ধ পানীয় জলের সুব্যবস্থা, কিছুটা হলেও ভদ্র বাসস্থান, বৈদ্যুতিক সংযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার সুব্যবস্থাসহ জীবন সুরক্ষাকারী সকল পণ্যদ্রব্যেরও সেব্যবস্থা করা জরুরি। যাতে এই শ্রমিক মানুষগুলোও যেন বুঝতে পারে যে, সবার মত তাদের জীবনগুলোও মহা মূল্যবান। যে ভয়ানক বৈষম্য আজ চা- শ্রমিকদের ও তাদের পরিবার পরিজনদের মৃত্যুর দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তা নির্মূল করতে সরকার, বাগান মালিকপক্ষ ও ম্যানেজমেন্টদের ভাবতে বাধ্য করানো আজ সময়ের দাবী। একমাত্র তা হলেই এই নীরব মহামারীর যন্ত্রণা ঠেকানো সম্ভব। শোষিত, বঞ্চিত, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এই চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের সফলতা কামনা করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে শোকের আগুন
পরবর্তী নিবন্ধহাওয়া, বদ্ধ সিনেমা এবং আমাদের পরশ্রীকাতরতা