কথাশিল্পীর মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা কিছুটা কল্পনা ও কিছুটা বাস্তব অভিজ্ঞতার রসে তৈরি একেকটি গল্পের থিম বা কাহিনি। যদি কথাশিল্পী হয় একজন কবি, তাহলেই তার দেখার ভঙ্গি, স্বপ্ন, পরিচর্যা, জীবন বোধের সত্যানুসন্ধান ভিন্ন রকমের ছাপ ফেলে। বদলে যেতে থাকে অনেক কিছু। অনেকাংশে গল্পের বিবিধ ভাষিক চরিত্র, এমন কি প্লট নির্মাণেও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। চরিত্র–কে নির্মাণ কিংবা বিনির্মাণের ভেতর দিয়ে ঘটে কথাশিল্পীর উন্মেষ। একজন প্রকৃত কথাশিল্পী–ই পারেন জীবনবোধের নানান অন্ধিসন্ধি ধরে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে। পুর্বাহ্নে বলেছি, কবি যদি কথা শিল্পী হয় তবে বাড়তি সৌন্দর্য –একটা মনোমুগ্ধকর আকাশ দেখতে পাওয়া যায়। সন্ধ্যেবেলার জুনি পোকার নাচন দেখতে পাওয়া যায়।
একটা সামাজিক বাস্তবতা বারংবার মনে রাখা দরকার। প্রত্যেক দেশের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক সংকট কিংবা প্রবহমানতা ভিন্নভাবে নির্মিত হবে এটাই স্বাভাবিক। সব রাষ্ট্রিক সমাজের বাস্তবতা এক রকম নয়, ভিন্ন সংস্কৃতির কারণে। আমরা পাশ্চাত্য সমাজ কাঠামোয় বাস করি না। মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অনাবশ্যক হাপিত্যেশ এবং বিষণ্নতাবোধ কোনও কারণ ছাড়াই কারণ হয়ে উঠবে। যা আমাদের সমাজে মানস চিন্তায় নেই কিংবা খানিক অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেটিকেই মূল ভেবে বাস্তবতা বিবর্জিত কাহিনির ফাঁদ তৈরি করে আনন্দিত হই। এতে যে নির্দিষ্ট সমাজ কাঠামোর সৃজনশীল চৈতন্য অবশ হয়ে ওঠে তা খেয়াল করি না। তার অর্থ এ–ই নয় যে সাহিত্য সৃজনশীলতার অগ্রসর অনুষঙ্গ আমরা ধারণ বা বহন করবো না একেবারেই। যতটা করণ–কৌশল, যতটা শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া দরকার অবশ্যই নেব। না হলে বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে এটপার হবে না আমদের সাহিত্য।
কবি গল্পকার মাহবুবা চৌধুরী, অনেক ক্ষেত্রে কাহিনির মান্যতা দিয়ে তার গল্পগ্রন্থ প্রজ্ঞাপারমিতাকে উৎকর্ষতা দেবার চেষ্টা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ছোট গল্প উপন্যাসের একটা চিত্ররূপ কণা। উপন্যাসের বড় ঘটনার একটি অংশ। তবে ছোট গল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাব্যসংজ্ঞা আজকাল অচল অনেকাংশে। গল্প ছোট হইলেই ছোট গল্প হয় না। সব উত্তীর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত ছোট গল্পের কিছু নান্দনিক শিল্পশর্ত থাকে। মাহবুবা চৌধুরীর প্রজ্ঞাপারমিতা পাঁচটি গল্প নিয়ে সূচি তৈরি হয়েছে।
প্রথম গল্প: সাতচল্লিশ নম্বর বাড়ি, বাসা বাড়ি দেখতে গিয়ে গল্পের প্রধান চরিত্র অদিতি নিজের অজান্তে কিছু সঙ্গ – অনুষঙ্গের গোলচক্করে পড়ে দ্বান্দ্বিক একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়। প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই অথচ অদিতি তুষারের অন্ধত্ব স্বীকার করতে পারে না। ভেতরের যন্ত্রণাদগ্ধ চিৎকার সামনে আনতে চায়, পারে না। খুব গভীর ভেতরের দ্বন্দ্ব সংঘাত শেষপর্যন্ত একটা মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি করে গল্পটা এগিয়েছে।
এটি হতেই পারে। মানুষের মনের সীমানা মাপা খুব কঠিন কাজ। সীমাহীন এবং অস্তিত্বহীন বলেই মনের গভীরতা অনুমান করা গেলেও দেখা যায় না। আমাদের সমাজে কিংবা বাইরের যেকোনো সমাজে বসবাসকারী মানুষের এরকমটা ঘটতে পারে। অদিতির অস্থিরতা, মনস্তাপ দারুণভাবে উদ্ভাসিত। তুষার অনেকটা নিস্প্রভ। অন্যদিকে দেখা না দেখায় অদিতির ভেতরকার উলটপালট বোঝা যায়। তবে চরিত্রের যেন একটা বোঝাপড়া আছে।
‘অবন্তী’ গল্পটি প্রচণ্ড মনস্তত্ত্বের ঘুর্ণিপাকে শেষ হয়েছে। ত্রিভুজ প্রেম না হ‘য়েও অসম্ভব দ্বন্দ্ব সংঘাত এবং টানাপোড়েনে অবন্তী, শান্তনু এবং শান্তুনুর বন্ধু অতীশ এর দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি পাঠককে ভাবিত করে, ভয়ার্থ করে তোলে।
অবন্তী ও আকিব এর চাকরি সূত্রে শ্রীমঙ্গলে আসা। ঘটনাসূত্রে শ্রীমঙ্গল চা বাগানে চাকরি করতো শান্তুনু ও অতীশ। অবন্তী ও শান্তুনুর গভীর প্রেমে ভেসে যাওয়ার গল্প জানতেন অবন্তীর পরিবার। কিন্তু তিনি শান্তুনুর মতো একজন মধ্যবিত্তের প্রেম মানবেন কেন। এটিই দ্বন্দ্ব সংঘাতের মূল। ফলে অবন্তীর বাবার নির্দেশে ভাড়া করা খুনিদের দ্বারা শান্তুনু ও বন্ধু অতীশ –কে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এমনভাবে নিভৃত চা বাগানের গভীর পাহাড়ে খুন করা হয়, যাতে কেউ জানতে না পারে। মূলত ঘটনার সত্য কেউ কখনোই লুকাতে পারে না। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে অবন্তীর স্বয়ংক্রিয় হ্যালুসিনেশন ঘটে। এক সকালে কেউ একজন তাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে খুব ভোরে ঘুম থেকে ডেকে দেয়। ঘুম ভেঙে সে অবন্তী কাউকে দেখতে পায় না। সে নতুন জায়গার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য বেরিয়ে পড়ে। যেতে যেতে আবিষ্কার করে ছোট্ট একটা টিলা মতো পাহাড়। সে যেন কিসের টানে উপরে উঠতে চায়। অতীশের ছায়া শরীর তাকে পথ দেখিয়ে পাহাড়ের উপরে নিয়ে যায়। সেখানেই অবন্তী আলো আবছায়ায় দেখতে পায় প্রেমিক শান্তুনু –কে। নানান প্রশ্ন –উত্তর এবং অবশেষে একটা সত্য বেরিয়ে যায় অবচেতন মনে। আসলে শান্তুনু বা অতীশের শারীরিক কোনও অস্তিত্ব নেই। দুজনেরই ছায়া নিয়ে সে চূড়ান্ত স্বাপ্নিক অবচেতনায় মেতেছিল। এই হেল্যুসিনশনে বেরিয়ে আসে হত্যাকারীর নাম বাবার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে। গল্পটির ম্যাসেজ এখানেই সত্য যতই কঠিন হোক, যত আড়ালেই থাকুক না কেন তা যে কোন মুহূর্তেই বেরিয়ে আসবে। একটা দুর্দান্ত মনস্তাত্ত্বিক গল্প ভাষা ও বিষয়ে। বিশ্ব সাহিত্যে এ ধারার গল্পের যে কজন তুমুল জনপ্রিয় লেখক তাঁরা হলেন ; জেমস জয়েস, ফ্লানৎস কাফকা, সিগ্মুন্ড ফ্রয়েড ও দস্তেয়ভস্কি। বাংলা ভাষায় মনস্তত্ত্বের মতো কঠিন বিষয় নিয়ে গল্প উপন্যাসে মেতেছিলেন, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মনের ভাবাবেগ ও কাহিনির চারিত্রিক দ্বন্দ্ব সংঘাত–কে ভাষা ও বিষয়ের মুন্সিয়ানায় ফুটিয়ে তোলার ক্যারিশমা হচ্ছে মনস্তত্ত্ব। মাহবুবা চৌধুরীর অবন্তী গল্পের চরিত্রগুলো সংক্ষিপ্ত হলেও দ্বন্দ্বমুখর গভীর। অসাধারণ ছুঁয়ে গেল প্রতিটি চরিত্র।
নিঃশঙ্ক বাড়ি ফেরা; গল্পের সৌমেন নিঃশঙ্কোচে একজন প্রকৃত প্রেমিক পুরুষ। চাকরিচ্যুত, সকালে ঘুম থেকে ওঠে দেরি করে। বৌয়ের আয়ে সৌমেন ও সংসারের খরচ চলে। অফিসে কাজের চাপ স্বামীর কাজ না করা, রাত–বিরেতে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফেরা এসবের কারণে মধুর মেজাজ মাঝেমধ্যে খিটখিটে হতেই পারে। মাঝেমধ্যে সৌমেন এর পৌরষবোধ জেগে উঠতে চেয়েছে। মধু চলে যাওয়া তার কিছুই যায় আসে না যেন। কিন্তু কোথাও গভীরভাবে আটকে আছে মধুর অস্তিত্ব। দু‘জনের সিমেন্টড বন্ধন এক অদ্ভুত আবেগ তৈরি করে। সৌমেন পাগলপ্রায় মধুকে খুঁজতে বেরিয়ে যায়। অসহায় হরিণের মতো সৌমেন রাতে ঘরে ফিরে দেখে মধু আলো আঁধারে দাঁড়িয়ে… গল্পটি সমাজের দু‘জন খেটে–খাওয়া দম্পতির। সাধারণ বিষয় নিয়ে কাহিনি। অখণ্ড প্রেমের তবে শেষটা ষাট – সত্তর দশকের বাংলা সিনেমার মতো।
‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ গ্রন্থের নাম গল্পটি একটা নাম না জানা মেয়ের গল্প নিয়ে আবর্তিত। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। প্লেনের মধ্যে ধীরে ধীরে লেখক আবিষ্কার করেন সিটের পাশাপাশি বসা মেয়েটি একা। এবং জেনে যায় একা দুবাই যাত্রার উদ্যেশ্য। এটা আমাদের দেশে শুধু নয় পৃথিবীর বহু দেশে এ–সব ঘটনা এন্তার ঘটতে থাকে। নারীকে শুধুমাত্র ভোগের পণ্য বানিয়ে দেশ দেশান্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। আরব আমিরাতে এসবের আধিক্য বেশি।
লেখক শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে হায়েনার ছোবল থেকে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হন। দুবাইয়ের জন্য প্লেনে ওঠা মেয়েটি চট্টগ্রাম নেমে পড়ে। এখানে মেয়েটির দুঃসাহসিকতা, বিচার বুদ্ধি ও বিদ্রোহ আঁচ করা যায়। প্রচলিত গল্পের কাহিনি হলেও ঝরঝরে চরিত্র বিন্যাস। লেখকসহ দুটি চরিত্র নিয়ে কাহিনি এগিয়ে নেওয়া বেশ লেগেছে। গল্পটিতে একজন দুর্দান্ত সাহসী নারীর হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলে নেবার ক্ষমতাকে বাহবা দিতে হয়। নেতিবাচক ঘৃণ্য অপরাধবোধে জর্জরিত মেয়েটি শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক চিন্তা করতে পেরেছে, এটি লেখকের কারণে হয়েছে। লেখকের ভূমিকা এখানে যথাযথ বুদ্ধিবৃত্তিক সুন্দর ও শুভেচ্ছা মার্জিত। ‘এক গোছা সোনালি চিকুর’ ভীষণ রোমান্টিক গল্প। মহিলার এক গোছা সোনালি চিকুর অনুরাগের নস্টালজিক মন উন্মনা করে তোলে। অনুরাগ চিনলেও মহিলা চিনতে পারে না। একটা চিরকুট দুজনের অনুভবের সাক্ষী হয়ে মহিলাকে মুহূর্তে স্মৃতিকাতর করে তোলে। খুবই স্বাভাবিক কাহিনির ধরন ভাষার কারণে সুখপাঠ্য হ‘য়ে ওঠে।
মাহবুবা চৌধুরী‘র গল্পের কাহিনি একদম জটিল নয়। বলা যায় সাবলীল বিন্যাস। অপ্রচল নয় বহুলাংশে প্রচল সামাজিক কাহিনি। তবে, লেখকের ভাষা গল্পের চরিত্রকে গভীরভাবে টেনে নিতে পারে। কাহিনির প্রয়োজনে চরিত্রের শ্রেণিবিন্যাস লক্ষ্য হয়ে ওঠে। গল্পের সংলাপ স্বতঃস্ফূর্ত সুন্দর কাহিনির গতি ও ঠিকানা খুঁজে দেয়। কাহিনির গতিমুখে থাকে অনবদ্য গল্প বলার ভঙ্গি। সাধারণ পাঠক গল্পের কাহিনির সাথে খুব সহজে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারে।
আশির দশক থেকে গল্পের বিষয় ও ভাষায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে গল্পের চরিত্র যেমন কাহিনিকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি ইতিহাস ঐতিহ্য পুরাণ বিভিন্ন মতবাদ সিম্বলিক হ‘য়ে উঠছে এখনকার গল্পগুলোতে। মাহবুবা গল্পকে সেদিকটায় টার্ন করেননি। তিনি তার দেখা পরিপার্শ্ব, সমাজের ঘটে যাওয়া কাহিনির চিন্ময় ধারাভাষ্যকার।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।