‘উন্নয়ন ভাবনায় সঠিক পরিকল্পনা’ শীর্ষক একটি লেখা এর আগে আমি লিখেছিলাম, যা ২ মার্চ ২০২০ সংখ্যা আজাদীতে ছাপা হয়েছিল। ঐ লেখায় আমাদের দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক ও যথার্থ উন্নয়ন ভাবনা যে প্রতিপালিত হয় না বরং দায়সারাভাবে প্রকল্প গ্রহণ এবং পরবর্তীতে সংশোধনের নামে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর কথা লিখেছি। দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প প্রণয়নকালে পর্যটন জেলা বান্দরবানের কথা মাথায় না রাখার বিষয়টি সেই লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন চালুর তোড়জোর চলছে এখন। তার আগেই সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা দেখিয়ে দিয়ে গেল প্রকল্প পরিকল্পনায় ভয়াবহ রকমের গলদ। দোহাজারীর পর সাতকানিয়া উপজেলার যে স্থান থেকে নতুন রেললাইন লোহাগাড়া, চকরিয়া হয়ে কক্সবাজার গেছে এরমধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকা রয়েছে নিচু। যা বন্যা ও বৃষ্টির পানি প্রবাহের প্রাকৃতিক পথ। এ ধরনের নিচু এলাকায় পানি প্রবাহের জন্য যতগুলো কালভার্ট রাখার প্রয়োজন ছিল তা রাখা হয়নি। মাটি ভরাট করে নির্মিত উঁচু রেলপথের কারণে বন্ধ হয়ে যায় পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতিপথ। ফলে রেলপথ চালু হওয়ার আগেই ঘটে বিপর্যয়। বন্যার পানি প্রবাহিত হতে না পেরে বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া এলাকায় বন্যার পানিতে শত শত বাড়িঘর ও হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। নতুন রেললাইনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেখা গেছে এই রেললাইন হয়েছে পানি প্রবাহের প্রধান প্রতিবন্ধক। লাইনের পূর্বপাশের তুলনায় পশ্চিম পাশে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। স্থানীয় জনসাধারণ অভিমত ব্যক্ত করেন, অপরিকল্পিত রেলপথই তাদের সামনে নিয়ে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়।
পদ্মা সেতু হয়ে টুঙ্গীপাড়া যাওয়ার সময় দেখেছি সেখানে ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন থেকে ১৭ কিলিমিটার রেলপথ নির্মিত হয়েছে ওভারফ্লাইয়ের উপরে। কারণ এলাকাটি ছিল নিচু এবং তা বৃষ্টি বা বন্যার পানির জলাধার হিসেবে পরিচিত। ওভারফ্লাইয়ের উপরে রেললাইন যাওয়ায় সেখানে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে কোনও বিঘ্ন ঘটছে না। সেইরকম পরিকল্পনা কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণেও করা যেত। কিন্তু কেন করা হয়নি তা জিজ্ঞেস করবে কে? আমাদের দেশেতো জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। ২০১০ সালে দোহাজারী– কক্সবাজার–ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে একনেক প্রকল্প অনুমোদন করে ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকার। ২০১৬ সালে বিস্তারিত নকশা প্রণয়নকালে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার কোটি টাকায়। এই অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধির দায়ভার কার তাও থাকছে জবাবদিহিতার বাইরে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত সাম্প্রতিক বেশ কিছু সংবাদের উল্লেখ এখানে করছি, যেসব প্রকল্প পরিকল্পনায় ছিল অপরিপক্বতা ও খামখেয়ালির সুষ্পষ্ট চাপ এবং যা রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়ায়। দায়সারাভাবে প্রকল্প প্রণয়নের খেসারত দিতে হয় রাষ্ট্র তথা জনসাধারনকে।
সড়ক ও জনপদ বিভাগ যশোরে ভৈরব নদসহ কয়েকটি স্থানে নয়টি সেতু নির্মাণ করছে পানির স্তর থেকে কম উচ্চতায়। চালু নৌপথ সমূহে কোনও সেতু নির্মাণ করতে হলে বিধি মেনে করতে হয় এবং এজন্যে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। যেসব সেতু নির্মিত হয়েছে তার উচ্চতা কোনওটির সাড়ে ৪ ফুট, ৫ ফুট, ৭ ফুট থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১১ ফুট পর্যন্ত। অথচ বিধি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণির নৌপথে সেতুর উচ্চতা হতে হবে ৬০ ফুট, দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথে ৪০ ফুট, তৃতীয় শ্রেণির নৌপথে ২৫ ফুট এবং চতুর্থ শ্রেণির নৌপথে ১৬ ফুট। কিন্তু এখানে তা না মানায় এখন এসব নদ–নদীর অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সেতুর উচ্চতা খুবই কম হওয়ায় নিচ দিয়ে নৌযান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। বর্ষাকালে পানির প্রবাহ সেতুর কলাম ঘেঁষে হয় বলে ক্ষুদ্র নৌযানও চলাচল করতে পারছে না। বিআইডব্লিউটিএ বারবার আপত্তি দিয়েও ঠেকাতে পারেনি অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত এসব সেতুর কাজ।
চাঁদপুরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীর এলাকায়। সেজন্য জমি অধিগ্রহণে কেলেংকারির কারণে প্রকল্প কাজ শুরুতেই হোঁচট খায়। প্রভাবশালী কতিপয় আগেই কমদামে জমি কিনে তাতে রাতারাতি কিছু স্থাপনাও তৈরি করে রাখে। সেই জমিতেই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাবও পাঠানো হয়। স্থানীয় জেলা প্রশাসন তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছে যে জমিতে প্রকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে গেলে রাষ্ট্রের ৩০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে। এই রিপোর্টকে উপেক্ষা করা যায়নি তবে জেলা প্রশাসককে বদলি হতে হয়েছে।
সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠানের নতুন একটি কারখানা স্থাপন হবে মানিকগঞ্জে। সেজন্য প্রকল্প স্থান নির্ধারণ করা হয় সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীর নিজগ্রামে। যেটি উপজেলা সদর থেকেও অনেক দূরে দুর্গম এলাকায়। সেখানে প্রকল্প হবে জেনে প্রভাবশালীরা কমমূল্যে আগেভাগে জমি কিনে রাখে। তারপর সেই জমি প্রকল্পের কাজে অধিগ্রহণের ব্যবস্থা পাকাপাকি করে রাষ্ট্রের কয়েকশ কোটি টাকা ক্ষতির আয়োজনের সংবাদও আমরা পাঠ করি।
সদ্য প্রকাশিত সংবাদ, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পে মূলকাজ শুরুর আগেই সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়ছে ৪০৩ কোটি টাকা। জাতীয়, অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটির অনুমোদন দিয়েছিল ১ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকায়। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৭০ কোটি টাকায়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘ডেমু’ ট্রেনকে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয়ের একটি বড় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১৩ সালে চীন থেকে ২০ সেট ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডেমু) ট্রেন কেনা হয়েছিল ৬৩৪ কোটি টাকায়। যাত্রীসেবা আধুনিকায়নের নামে কেনা ডেমু ট্রেন দেশে আনার পর দেখা যায় ট্রেনগুলি আমাদের আবহাওয়া ও বিদ্যমান অবকাঠামোতে চলাচলের অনুপযোগী। আমাদের রেলস্টেশনে প্ল্যাটফর্মের যে উচ্চতা ডেমু ট্রেনের পা–দানি তার অনেক উপরে। যাত্রীদের ওঠা–নামায় সমস্যা হয়। ট্রেনগুলিতে কোনও টয়লেট নেই। জানালা খোলা যায় না, উপরের দিকে সামান্য ফাঁক করা যায়। ফলে ট্রেন চলার সময়ও এতে বাতাস ঢুকে না বলে যাত্রীদের গরমে সেদ্ধ হতে হয়। তারপরেও স্বল্পদূরত্বের কয়েকটি রুটে তা চালু করতে গিয়ে দেখা দেয় নানা জটিলতা। এসব জটিলতা দূর করতে ব্যয় হয় আরও ৫২ কোটি টাকা। বছর না যেতেই এসব ট্রেন বিকল হতে থাকে এবং সাত বছরের মধ্যে সব ডেমু ট্রেন মুখ থুবড়ে পড়ে। মোট ৬৮৬ কোটি টাকায় কেনা এসব ট্রেন পরিচালনা করতে গিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি খরচ ও কর্মচারীদের বেতন ভাতায় ব্যয় হয় আরও ৬০ কোটি টাকার মত। অর্থাৎ ৭৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ের ডেমু ট্রেন চালিয়ে সাতবছরে রেলের আয় হয়েছে মাত্র ২২ কোটি টাকা। এসব ট্রেন এখন রেলওয়ের ইয়ার্ডে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ডেমু ট্রেন মেরামতের জন্য রেলের কোনও ওয়ার্কশপ নেই। এই ট্রেনের স্পেয়ার পার্টসও পাওয়া যায় না। ফলে অকেজো হয়ে পড়ে থাকা ট্রেনগুলোকে স্ক্রাপ হিসেবেই এখন গণ্য করা যায়। এই অপরিকল্পিত ও অবাস্তব প্রকল্প রেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিসাধন যারা করেছেন তাদের কোনও রকম জবাবদিহিতা করতে হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনও রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ফলে অসাধু চক্রটি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
তেমনই আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে–লাগেজ ভ্যান। রেলওয়ের আন্তঃনগর ট্রেনসমূহে সম্প্রতি লাগেজ ভ্যান যুক্ত করা হয়েছে। রেলমন্ত্রী তা আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধন করেছেন। এই প্রকল্পে ৩৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে কেনা হচ্ছে ৮ থেকে ৯ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ১২৫টি লাগেজ ভ্যান। এরমধ্যে ২৮ টি ফ্রিজিং লাগেজ ও ৯৭টি সাধারণ লাগেজ ভ্যান। ৫০টি ভ্যান দেশে এসেছে। বাকিগুলো চলতি বছরের মধ্যেই আসার কথা। এই প্রকল্প গ্রহণের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। লাগেজ ভ্যানের প্রতিটির ক্রয়মূল্যও অনেক বেশি ধরা হয়েছে। একটি যাত্রীবাহী কোচ কিনতে যে খরচ হয় এক্ষেত্রে তারচেয়েও বেশি হয়েছে, যাকে বিশেষজ্ঞরা অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করে বলেছেন, এভাবে প্রকল্প গ্রহণে দুর্নীতির শঙ্কা থাকে। তাছাড়া আন্তঃনগর ট্রেনে লাগেজ ভ্যান যুক্ত করার বিষয়টিও অযৌক্তিক।
সংবাদপত্রের খবর, যে ভ্যানগুলো আন্তঃনগর ট্রেনে যুক্ত করে চালানো শুরু হয়েছে সেখানে প্রত্যাশা অনুযায়ী পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায়সময় খালি যাচ্ছে। কারণ রেলপথের চেয়ে সড়কপথেই পণ্য আনা–নেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। সড়ক পরিবহনে পণ্য প্রেরক বা গ্রহীতার দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারে। আন্তনগর ট্রেনের দৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি। স্টেশনে থামে ৩ থেকে ৪ মিনিট। লাগেজ খালাসে সময় লাগে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট। অধিকাংশ স্টেশন প্ল্যাটফর্মেই এর জায়গা হয় না। ট্রেনের পেছনে যুক্ত লাগেজ ভ্যান প্ল্যাটফর্মের অনেক বাইরে থাকে বলে মালামাল তোলা– নামায় সমস্যা হয়। এতে আন্তঃনগর ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়ের শঙ্কাও করা হচ্ছে। কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, লাগেজ ট্রেনে পণ্য পাঠাতে মানুষের আগ্রহ কম। এমন পরিস্থিতিতে লাগেজ ভ্যানগুলোর অবস্থাও ডেমু ট্রেনের মত হয় কিনা সে নিয়ে সন্দিহান রেল অপারেশনে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই।
ডেমু ট্রেনের প্রকল্প গ্রহণ করে ররাষ্ট্রের ৬৮৬ কোটি টাকা অপচয়ের জন্য কাউকে কোথাও জবাবদিহি করতে হয়নি। লাগেজ ভ্যান প্রকল্পও যদি মুখ থুবড়ে পড়ে সেক্ষেত্রেও কিছু হবে তেমনটা আশা করা যায় না। যারা অবাস্তব উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করে এবং যারা তা পাশ করে জনগণের ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকার অপচয় করে তাদের বিরুদ্ধেও কোনও রকম বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নজিরও আমাদের সামনে নেই।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।