ঢাকার দুই সিটির চেয়ে পাঁচ শতাংশ বেশি পৌরকর (গৃহকর ও রেইট) আদায় করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। আবার চট্টগ্রামে পৌরকর নির্ধারণ পদ্ধতি নিয়েও আছে নানা অভিযোগ। এজন্য অতীতে রাজপথে নেমেছিলেন ভবন মালিকগণ। জাতীয় সংসদেও হয়েছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। অন্যদিকে পৌরকর আদায় না হলে গতি হারায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধেও বেগ পেতে হয়। তাই সহনীয় পৌরকর নির্ধাণ ও আদায়ের লক্ষ্য অর্জন মেয়রের কাছে সবসময় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটে ঘনিয়ে আসছে চসিক নির্বাচন। ভবন মালিকগণ চেয়ে আছেন নতুন মেয়রের দিকে। তাদের প্রত্যাশা পৌরকর সহনীয় পর্যায়ে রাখবেন নতুন মেয়র। মানুষ দিতে পারবেন না এমন পৌরকর ধার্য্য করবেন না তিনি। ঢাকার চেয়ে কম না হলেও অন্তত সমান পৌরকর নির্ধারণ করবেন। এক্ষেত্রে সহনীয় কর নির্ধারণের চ্যালেঞ্জ নতুন মেয়র নিবেন কিনা সে প্রশ্নও আছে ভবন মালিকদের।
সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, পৌরকর নির্ধারণে আইনি বাধ্যবাধকতাও। ফলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি যাই দিক পৌরকর নিয়ে দায়িত্ব নেয়ার পর মেয়রকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। কারণ, এখানে আইনি বাধ্যবাধকতার বাইরেও আরো কিছু বিষয় পৌরকরের সাথে জড়িত। যেমন- রাজস্ব আয়ের মূল উৎস পৌরকর। নগরবাসীর সার্বিক সেবা প্রদান নিশ্চিতকল্পে চসিকে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাৎসরিক বেতন-ভাতাদি পরিশোধ, নগরীর আবর্জনা অপসারণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণ, সড়ক আলোকায়ন, শিক্ষা সেবা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বহুমুখী কর্মকাণ্ডের সিংহভাগ ব্যয় পৌরকর থেকে নির্বাহ করা হয়। পৌরকর আদায় কমে গেলে খাতটির আয়ের উপর নির্ভরশীল সেক্টরগুলো থমকে যায়। করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৪ মে পর্যন্ত পৌরকর আদায় সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এরপর ৫ মে থেকে আদায় শুরু হলে পরবর্তী দুই মাস আদায়ের হারও ছিল কম। এর প্রভাবে এপ্রিল ও মে মাসে নির্দিষ্ট তারিখে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারি ও বেসরকারি ভবনের বিপরীতে চসিক সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ পৌরকর আদায় করে থাকে। এর মধ্যে ২৫টি ওয়ার্ড থেকে ১৭ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ১৬টি ওয়ার্ড থেকে আদায় করা হয় ১৪ শতাংশ। ১৭ শতাংশের মধ্যে ৭ শতাংশ গৃহকর, ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন রেইট এবং ৭ শতাংশ আর্বজনা অপসারণ বা পরিচ্ছন্ন রেইট রয়েছে। ১৪ শতাংশ আদায় করা ওয়ার্ডগুলো থেকে ৭ শতাংশ গৃহকর ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন রেইট এবং ৪ শতাংশ আর্বজনা অপসারণ বা পরিচ্ছন্ন রেইট আদায় করা হয়।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন আদায় করে ১২ শতাংশ পৌরকর। এর মধ্যে এরমধ্যে গৃহকর ৭ শতাংশ, আলোকায়ন রেইট ৩ শতাংশ এবং বর্জ্য অপসারণ রেইট রয়েছে ২ শতাংশ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনও ১২ শতাংশ পৌরকর আদায় করে থাকে। এর মধ্যে গৃহকর ৭ শতাংশ, আলোকায়ন রেইট ২ শতাংশ, বর্জ্য অপসারণ রেইট ২ শতাংশ এবং স্বাস্থ্যকর রয়েছে ১ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, নগরে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৬৬ টি হোল্ডিং আছে। এর মধ্যে সরকারি এর মধ্যে সরকারি হোল্ডিংয়ের সংখ্যা এক হাজার ৫১৬টি এবং বেসরকারি হোল্ডিং আছে এক লাখ ৯৪ হাজার ২৫০টি।
‘সিটি কর্পোরেশন (কর) বিধি ১৯৮৬ এর ১৯, এবং ২১ অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এসেসমেন্ট হালনাগাদ বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিধি মেনে ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এসেসমেন্ট করে চসিক। যা ৩১ আগস্ট প্রকাশ হওয়ার পৌরকরের পরিমাণ বেড়েছে বলে আপত্তি জানান ভবন মালিকরা। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে আন্দোলন শুরু করে টানা কর্মসূচি পালন করে করদাতা সুরক্ষা পরিষদ নামে একটি সংগঠন। তৎকালীন মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে হয়েছিল ‘শব্দযুদ্ধ’ও। কর সহনীয় রাখার প্রস্তাব দিয়ে তৎকালীন মেয়রকে চিঠি দিয়েছিলেন সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম। পরবর্তীতে ১৬ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মন্ত্রী-এমপিরা।
একই বছরের ২৬ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন মন্ত্রণালয়টির শীর্ষ কমর্তকর্তারা। এরপেক্ষিতে ২৭ নভেম্বর থেকে এসেসমেন্ট কার্যক্রম স্থগিত করেছিল চসিক। ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থগিত হওয়া পঞ্চবার্ষিকী কর মূল্যায়ন এর আলোকে পৌরকর আদায়ের অনুমতি চেয়ে মন্ত্রণালয়ে পত্র দেন। এরপ্রেক্ষিতে ২৫ অক্টোবর শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে মন্ত্রণালয়।
আমীর হোসেন নামে এক ভবন মালিক আজাদীকে বলেন, সহনীয় থাকলে সবাই নিজ দায়িত্বে পৌরকর পরিশোধ করবেন। তাই নতুন মেয়রের উচিত হবে সহনীয় রাখা। এছাড়া স্থগিত হওয়া এসেসমেন্টকে আবার সামনে আনবেন না।
মেয়র প্রার্থীর বক্তব্য : আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, নির্বাচিত হলে গৃহকর সহনীয় রাখার চেষ্টা করব। সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মতো কর্পোরেশনের নিজস্ব আয় বাড়াতে জোর দিব। এজন্য আয়বর্ধক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রাজস্ব বাড়াতে চেষ্টা করব। পৌরকর সহনীয় পর্যায়ে রেখে সেমিপাকা ঘর, কাচাঘরের বিষয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর নীতি অনুসরণ করব। স্বল্প আয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে কিভাবে পৌরকরের চাপ থেকে মুক্ত করে বিকল্প ব্যবস্থায় তা পুষিয়ে নেওয়া যায় সেজন্যে বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে আমি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিব। ট্রেড লাইসেন্সসহ অন্যান্য পৌরকর দেশের বাকি সিটি কর্পোরেশনের সাথে তুলনামূলক যাচাই বাচাই করে কিভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নিব।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, জনগণের উপর বোঝা হয় এমন কিছু করার চিন্তা-ভাবনা আমার নেই। এমনভাবে পৌরকর নির্ধারণ করা হবে, যাতে জনগণের উপর বাড়তি বোঝা না হয়, আবার সিটি কর্পোরেশনও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমার পরিকল্পনা আছে সিটি কর্পোরেশনকে স্বনির্ভর করার। আরবান হেলথ প্রকল্প, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎসহ নানা আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করব। বন্দর ও কাস্টম সিটি কর্পোরেশনের অবকাঠামো বেশি ব্যবহার করে সে তুলনায় তাদের কাছ থেকে রাজস্ব কম আদায় হয়। আমার চেষ্টা থাকবে তাদের কাছ থেকে বেশি করে পৌরকর আদায় করে জনগণের উপর চাম কমানোর।