পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের পশ্চিম গোঁয়াখালী কাটাফাঁড়ি ব্রিজ পাড়া। এলাকাটি এখন ‘টুপি পল্লী’ হিসেবেই অধিক পরিচিতি লাভ করেছে। কারণ এ এলাকার শতাধিক নারী টুপি বানিয়েই আয় করে সংসার চালান। স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাও অবসর সময়ে টুপি বানিয়ে তা বিক্রি করে পড়ালেখার খরচ জোগাড় করেন। তাদেরই একজন জোসনা আক্তার। তার স্বামী একজন রিক্সাচালক। স্বামীর আয়ে সংসার চলে না তার। তাই পাড়ার অন্য মেয়েদের মত তিনিও অবসর সময়ে টুপি বানিয়ে জোগাড় করেন সংসার খরচ। জোসনা জানান, সংসারের কাজ শেষ করে যেটুকু সময় পাই সেই সময়টুকু কাজে লাগিয়ে টুপি বানাই। আর এ টুপি বিক্রি করে যা পাই তাতে আমার সংসারে যোগান দেই।
টুপি পল্লীতে দেখা যায়, নদীর পাড়ের একটি টিনের চালা বেড়ার ঘরের বারান্দায়। ঘরটি বেশ পরিপাটি। ঘরের বারান্দায় বসে এক নববধু ছন্দে ছ৬ন্দে দুই হাতে সুঁই সুতা চালিয়ে যাচ্ছেন শৈল্পিক ভঙ্গিতে। কাছে গিয়ে নববধুর সাথে কথা বলতে চাইলেই লজ্জায় ঘুমটায় মুখ ঢাকেন তিনি। পরে তার সাথে কথার এক পর্যায়ে তিনি জানান, তার নাম রিপু আক্তার। এ এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের সাথে বিয়ে হয়েছে মাস পাঁচেক হয়। এরই মধ্যে পাড়ার রুজিনা আক্তার নামের এক নারীর উৎসাহেই তিনি টুপি বানাতে শুরু করেন। প্রত্যেক মাসের শেষে এক পাইকার এসে তাদের বানানো টুপিগুলো পাইকারী দামে কিনে নিয়ে যান। তিনি জানান, তারা বিভিন্ন দামের টুপি বানান। একটি টুপি সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। মাসে ১০-১৫ টি টুপি বানাতে পারেন একেকজন। তিনি বলেন, অলস বসে না থেকে টুপি বানিয়ে বাড়তি ইনকাম করি আমরা। আয়ের দিক দিয়ে সামান্য হলেও অলস সময়টা কাজে লাগিয়ে অন্তত হাত খরচের টাকাটা জোগাড় করতে পারাটা তেমন মন্দ নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আরও দেখা যায়, বিকেলে নারীরা ঘরের বাইরে সারি সারি বসে ছুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন আর সুঁই সুতায় দুই হাত চালিয়ে যাচ্ছেন। কথা হয় স্কুল ছাত্রী মায়া, সুমি, হালিমা, রেশমী, ইসমত আরা, হুসনা, উর্মি, মুবিনা, চুমকিসহ আরো অনেকের সাথে। এদের মধ্যে উর্মি আর মুবিনা পড়েন সুদূর উপজেলা সদরের পেকুয়া জিএমসি ইনস্টিটিউশনের ৯ম শ্রেণীতে। চুমকি আর সুমি পড়েন স্থানীয় পাবলিক স্কুলে। হুসনা আর রেশমী সবে প্রাইমারীর গন্ডি পেরিয়েছে। তারা সকলেই জানান, করোনার কারণে এখন স্কুল বন্ধ তাই বিকেলের সময়টি অলস না কাটিয়ে তারা টুপি বানান। এতে মাস শেষে তাদের পড়া লেখার খরচ জোগাড় হয়। ফলে তাদের দরিদ্র পিতাকে আর খরচের জন্য জ্বালাতে হয়না। উর্মি আর মুবিনা জানান, তারা পাড়ার অন্য নারীদের দেখাদেখি টুপি বানানো শিখেছেন আর টুপি বিক্রি করে তাদের পড়ালেখার খরচ জোগাড় হয়। তারা বলেন, তাদের টুপি শিল্পকে যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয় তাহলে এলাকার সব নারীই এ কাজে সম্পৃক্ত হবে। ফলে এলাকায় অপরাধ প্রবণতা কমার পাশাপাশি স্থানীয় নারীরা স্বাবলম্বী হবে।
এবার কথা হয় যার উৎসাহে পাড়ার শতাধিক নারী টুপি বানান সেই রুজিনা আক্তারের সাথে। তিনি স্থানীয় মহিউদ্দিনের স্ত্রী। তিনি জানান, ‘প্রথমদিকে এ গ্রামে আমরা দু-একজন নারী টুপি বানাতাম। কিন্তু পর্যায়ক্রমে এ পাড়ার প্রায় সব নারীই এ কাজে জড়িয়ে যায়। কারণ টুপি বানাতে তেমন কোন পুঁজির দরকার নেই। টুপি বানানোর জন্য শুধুমাত্র একটি সুঁই আর সামান্য সুতা হলেই যথেষ্ট। অবসর সময়ে অহেতুক সময় না কাটিয়ে টুপি বানিয়ে রাখলে মাস শেষে পাইকার এসে নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যান। এতে লাভবান হচ্ছে নারীরা।’ তাছাড়া অবসর সময়ে কাজে ব্যস্ত থাকায় বিবাহিত নারীদের সংসারেও ঝগড়াঝাটি অনেক কম হয় বলে হাসতে হাসতে মন্তব্য করেন তিনি। যে পাইকার এ পাড়া থেকে প্রতিমাসে টুপি সংগ্রহে আসেন তিনি হলেন, ছমিউল্লাহ। ফোনে কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান, তিনি পাড়া থেকে টুপিগুলো সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের পাইকারদের বিক্রি করে আসেন। ৫০ টাকায় কিনে সে টুপি তিনি ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি করেন। এতে তিনিও লাভবান হচ্ছেন। তিনি বলেন, এ এলাকার নারীরা একজন আরেকজনের দেখাদেখি টুপি বানাতে উৎসাহিত হয়ে এখন এ এলাকার প্রায় শতাধিক নারী নিয়মিত টুপি বানান।
স্থানীয় এমইউপি নুরুল হক সাদ্দাম জানান, পশ্চিম গোঁয়াখালী কাটাফাঁড়ি এলাকাটি একটি দরিদ্র্যপীড়িত এলাকা ছিল। এ এলাকায় একসময় নারীদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকত। কিন্তু বর্তমানে সবাই টুপি বানানো শিল্পে জড়িত হওয়ায় এখন আর ঝগড়াঝাটির বিচার করতে হয়না। বরং প্রতিযোগিতা দিয়েই এ এলাকার নারীরা টুপি বানান। তিনি বলেন, সরকারি সহায়তা পেলে এ এলাকার নারীদের টুপি বানানোকে একটি শিল্পে রূপ দেয়া সম্ভব।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোতাছেম বিল্ল্যাহ জানান, পেকুয়ার টুপি পল্লীর নারীদের সম্মিলিত এ উদ্যোগ নিশ্চয়ই সামাজিক অবক্ষয় রোধে ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় নারীরা অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে টুপি বানিয়ে আয় করে সংসারে অর্থ যোগান দিচ্ছে বা পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছে এটি একটি সমাজের জন্য অত্যন্ত পজিটিভ বিষয়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয় নারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার চিন্তা রয়েছে আমাদের।