দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেছেন, একুশ আমার অহংকার। একুশ মানে মাথা নত না করা। এটা আমি ১৯৫২ সালে ধারণ করেছিলাম। আপনারা জানেন, একুশের সঙ্গে আমাদের পরিবার এবং আমাদের প্রেস ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। আমার বাবা ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ আমাদের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছাপিয়েছিলেন। রাতে ছাপানো মাহবুব উল আলম চৌধুরীর রচিত এ কবিতা পরদিন লালদীঘি ময়দানে বিলি করা হয়। কিন্তু সুখের কিংবা দুঃখের বিষয় ছিল, সেই কবিতার প্রিন্টার্স লাইনে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস লেখা ছিল। সুতরাং বুঝতেই পারছেন। সরকারকে আর বেশি কিছু করতে হয়নি। পরদিন আমার বাবাকে ধরার জন্য প্রেসে পুলিশ এসেছিল। কিন্তু আমাদের ম্যানেজার দবির উদ্দিন পুলিশকে বললেন, উনি (এম এ মালেকের বাবা ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেক) কিছু জানেন না। ওনাকে না জানিয়েই আমি ছাপিয়েছি। যা করার আমাকে করতে হবে। এ কারণে বাবা বেঁেচ যান। এ ঘটনায় মামলা হয় এবং ম্যানেজারের জেল হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসলে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।
তিনি গতকাল বুধবার বইমেলা মঞ্চে ছড়া উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে এ বইমেলার আয়োজন করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। কবি ও সাংবাদিক রাশেদ রউফের সভাপতিত্বে ছড়া উৎসবে প্রধান আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সাবেক পরিচালক আনজির লিটন। ছড়াকার সনজীব বড়ুয়া বিশেষ আলোচক ও শিশুসাহিত্যিক অরুণ শীল আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন। শিশুসাহিত্যিক আ.ফ.ম মোদাচ্ছের আলীর সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন, মেলা কমিটির আহ্বায়ক ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু।
এম এ মালেক আরো বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পায় ১৯৯৯ সালে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন আমরা শুরু করেছিলাম। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। মাতৃভাষার জন্য আমাদের দামাল ছেলেরা তাদের বুকের রক্ত দিয়েছিল। রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে আমরা অর্জন করেছি। পৃথিবীর কোনো দেশে কেউ এ অর্জন করতে পারেনি। সেদিক থেকে আমরা অনেক ভাগ্যবান।
এবার একুশে পদক পাওয়া এম মালেক বলেন, আজকে যদি বাংলাদেশ না হতো তাহলে একুশে পদকের মূল্য পাকিস্তান সরকার দিতো না। একুশের আবেদনও আমাদের কাছে সেভাবে উপস্থাপিত হতো না। এ সময় তিনি বলেন, একুশে পদক পাওয়ার যে সুযোগ আমার হয়েছে সে গৌরব আমার চেয়েও চট্টগ্রামবাসীর, আজাদী পত্রিকার। আজাদীকে সবসময় আমি পরিবার বলে থাকি। এ পরিবারের সদস্যরা যদি দীর্ঘ বছর ধরে আমার সঙ্গে না থাকতো তাহলে আজাদী এ মর্যাদাপূর্ণ স্থানে এসে পৌঁছুতে পারত না।
তিনি বলেন, অনেকেই ঢাকা থেকে আজাদী কেন বের করি না জানতে চান। ঢাকা থেকে বের করার মতো উপযুক্ত কোনো কারণ নেই। ঢাকা থেকে বেরুলে সেটা জাতীয় এবং ঢাকার বাইরে হলে সেটা বিজাতীয় অর্থাৎ মফস্বলের কাগজ হয়ে যায়। মফস্বলের কাগজ বলে কোনো কাগজ আমি বিশ্বাস করি না। আমার বাবা চট্টগ্রামের জন্য কাগজ বের করেছিলেন। আজাদী চট্টগ্রামের কাগজ। চট্টগ্রামের কাগজ হয়েই থাকবে। কখনো ঢাকা থেকে বের করার কোনো চেষ্টা করবো না। আমি মনে করি আমার ছেলেরাও করবে না।
তিনি বলেন, একটি বই দশজন ভালো বন্ধুর সমান। সুতরাং বই সবসময় আমাদের কাছে থাকতে হবে। বইয়ের এতই শক্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কার্ল মার্কস, লিও টলস্টয়, অমর্ত্য সেনসহ আরো যারা আছেন তারা তাদের লেখনি দিয়ে পুরো সমাজকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, জানতে হবে। পড়তে হবে। যত বেশি জানব তত বেশি আমাদের চিন্তাশক্তি বাড়বে এবং যত বাড়বে তত নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
তিনি বলেন, আমরা যারা পৃথিবীতে আছি সবাই পথিক বলি। হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র পথিকৃৎ হতে পারে। কিন্তু সমাজের জন্য কিছু করে পথিকৃৎ হওয়ার জন্য সকলকে চেষ্টা করতে হবে। তাহলে সমাজের জন্য উপকার হবে।
বই প্রকাশের জন্য সরকারের ভর্তুকি দেয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, বই জ্ঞানের বস্তু। বই পড়লে সুন্দর সমাজ গড়ে উঠবে। সেখানে সরকার নিশ্চয়ই ভর্তুকি দিতে পারে। সেজন্য একটি কমিটি গঠন করতে পারে। যারা ভালো লেখক তারা মানসম্পন্ন লেখা লিখে কমিটিকে জমা দিতে পারে। কমিটি যদি মনে করে ভর্তুকি পাওয়া উচিত তাহলে ওই বই প্রকাশে ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এম এ মালেক বলেন, বাংলা একাডেমি কিছু বই প্রকাশ করছে। কিন্তু এর বাইরেও তো অনেক ভাল বই থেকে যাচ্ছে। সেখানে একটু ভর্তুকি দিলে কিছুই হবে না। কত টাকাই বা দিতে হবে। ফিল্ম করার জন্য তো দেয়। ফিল্মের জন্য দিতে পারলে বইয়ের জন্য কেন দিতে পারবে না। নিশ্চই পারবে।
আনজির লিটন বলেন, চট্টগ্রামকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। চট্টগ্রামের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং এর বিপ্লবী চিন্তা-চেতনা আমার বেড়ে উঠার সময়কালের জন্য অনেক বড় ইতিহাস। তিনি বলেন, আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্বাধীনতা পদক, বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন আজাদীর সহযোগী সম্পাদক রাশেদ রউফ। আমি আজাদীকে স্যালুট জানাই।
তিনি বলেন, আমি আজাদীকে বাংলাদেশের স্মারক মনে করি। নিশ্চয় আপনারাও সেটা মানবেন। আজাদী পত্রিকার অনেক বড় ইতিহাস আছে। শুধু চট্টগ্রামের না, বাংলাদেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে আজাদী। এ ছড়াশিল্পী বলেন, বাংলাদেশ এমনি এমনি হয়নি। বাংলাদেশ কীভাবে হয়েছে সেটা ভাবেন। বাংলাদেশের পটভূমি সবাইকে অনুভব করতে হবে। সেই অনুভবের কথাগুলো ছড়াকার তার ছড়ার মধ্য দিয়ে নানাভাবে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের যে শক্তি ও এতিহ্য তা ছড়াকাররা ছন্দে ছন্দে তুলে এনেছেন। বঙ্গবন্ধু যেভাবে গড়তে চেয়েছেন সেভাবে বাংলাদেশকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এগিয়ে নেব।
তিনি বলেন, বর্তমান প্রজন্ম ৫২ এর ইতিহাস এবং ২৬ মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা সেভাবে হয়তো জানে না। কিন্তু তাদের জানানোর দায়িত্ব অবিভাবকদেরও। রাজনীতিবিদ যেভাবে রাষ্ট্রের পথ দেখান একজন অবিভাবক তার পরিবারের সন্তানদের মধ্য দিয়ে একটি সমাজের পথ দেখান। পরিবারই পারে সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে।
রাশেদ রউফ বলেন, মানুষকে জ্ঞানে, শিক্ষায় ও আধুনিকতায় সমৃদ্ধ করতে চাইলে দরকার সবাইকে বইমুখি কর। তিনি বলেন, ছড়ার মধ্যে চিরকালীন রূপ আছে। সমকালকে ধারণ করে ছড়া। বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদে স্লোগান হয়ে উঠে ছড়া। স্বৈারাচার বিরোধী আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছিল ছড়াকাররা।
সনজীব বড়ুয়া বলেন, ছড়ার মধ্যে আনন্দ আছে, একপ্রকার বিস্তৃতি আছে। ঘুমপাড়ানি ছড়া একসময় ঘুম তাড়ানি এবং জাতিকে জাগানোর মাধ্যম হয়ে উঠে। ছড়ার সমকালীন আবেদন মারাত্মক। ছড়ায় মানবিক আবেদনও প্রবল।
এদিকে আলোচনা সভার ফাঁকে ফাঁকে স্বরচিত ছড়া পাঠ করে দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন চট্টগ্রামের ছড়াকাররা। ছড়া পাঠ করেন -বিপুল বড়ুয়া, অরুণ শীল, আবুল কালাম বেলাল, লিটন কুমার চৌধুরী, সাইফুদ্দিন সাকিব, গোফরান উদ্দিন টিটু, দীপক বড়ুয়া, ফারুক হাসান, নিশাত হাসিনা শিরিন, তালুকদার হালিম, জুবায়ের জসীম, বাসুদেব খাস্তগীর, সৈয়দ খালিদুল আনোয়ার, জসীম মেহবুব, কেশব জিপসী, ইকবাল বাবুল, এয়াকুব সৈয়দ, ইফতেখার মারুফ, এমরান চৌধুরী, অমিত বড়ুয়া, ফারজানা রহমান শিমু, উৎপল কান্তি বড়ুয়া, সনজিত দে, আজিজ রাহমান, সৈয়দা সেলিমা আকতার, মিলন বণিক, মিজানুর রহমান শামীম, আকতারুল ইসলাম, নজরুল জাহান, আবু তালেব বেলাল, রুমু বড়ুয়া, অপু চৌধুরী।
এদিকে গতকালও মেলাজুড়ে পাঠকের ভিড় ছিল। নতুন বইয়ের খোঁজ করেন তারা। পাঠকের আগ্রহে থাকা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে কালাম চৌধুরীর ‘চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু’, তাপস চক্রবর্তীর ‘শেষ পথের রেখা’, সুকুমার বড়ুয়ার ‘রাউজানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’, ফয়জিয়া নূরের ‘হৃদভিটায় বসতি’। সুকুমার বড়ুয়া বলেন, রাউজানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে আমি যতই দেখেছি, তত সাধারণ মানুষের সংস্পর্শ লাভ করেছি। এতে আমার ইতিহাস লেখার পথ সুগম হতে থাকে। রাউজানের প্রতিটি এলাকার মানুষের জন্য আমার ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। এ ভালোবাসায় আমাকে উদ্ধুদ্ধ করেছে ‘রাউজানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ লিখতে।












