প্রতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে জাতীয় কন্যা–শিশু দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশের সমাজে যাতে নারীরা ভেদাভেদ বা বৈষম্যের শিকার না হন, সেদিকটি বিবেচনায় রেখে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে বিগত দু’হাজার সালে বাংলাদেশ সরকারের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘জাতীয় কন্যা–শিশু দিবস’ পালনের আদেশ জারি করে। তারই ধারবাহিকতায় ‘কন্যাশিশুর স্বপ্নে গড়ি আগামীর বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে এ–বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় কন্যা শিশু দিবস পালিত হয়। কিন্তু দেখার বিষয় হলো, অতীতের মতো এই প্রতিপাদ্যও কি কেবল সভা–সেমিনারের আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকবে?
আমরা জানি, সারা বিশ্বেই নানা কারণে কন্যা–শিশুরা বেশ অবহেলিত, নিগৃহীত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মর্যাদা, ভালোবাসা…সব দিক থেকেই বলতে গেলে তারা বঞ্চিত। শুধু যে আমাদের দেশেই এমন চিত্র তা কিন্তু নয়। সারা বিশ্বেই কোনো না কোনো জায়গায় প্রতি মুহূর্তে অবহেলার শিকার হচ্ছে কন্যা–শিশু। পরিবার ছাড়াও সামাজিকভাবেও তারা হচ্ছে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত। সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রসহ সকল স্থানে নারী–পুরুষের ভেদাভেদ দূরীকরণও কন্যা–শিশু দিবস পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য। গৃহ–পরিবেশে একজন পুত্রসন্তানকে যেভাবে গুরুত্ব সহকারে আদর–যত্নে লালনপালন, শিক্ষার প্রতি যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেভাবেই একজন কন্যা–শিশুর মানসিক নিপীড়নের হাত থেকে মুক্ত করার কথাই উচ্চারিত হয়ে থাকে এ দিবসে।
কথায় বলে, মেয়ে হয়ে জন্মালে না–কি অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। মানিয়ে নিতে হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে। জন্ম থেকেই একজন কন্যাশিশুকে আবদ্ধ করা হয় বৈষম্যের ঘেরাটোপে। সেটি শুরু হয় পোশাক কিংবা খাবারের থালা থেকে। বর্তমানে আমরা সমাজ সংষ্কার তথা আধুনিকায়ন নিয়ে মাতামাতি শুরু করলেও আমাদের পুরুষতান্ত্রিকান্ত্রিক সমাজ মস্তিষ্ক ও মননে কন্যাশিশুদের বিষয়ে কতটা আধুনিক হয়ে উঠছে বা সেদিকে পা বাড়িয়েছে, সেটি বিরাট প্রশ্ন সাপেক্ষ আলোচনা।
একুশ শতকে কন্যাশিশুরা বিশ্বে বাধাহীন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এ সময়েও আমাদের সমাজে কন্যাদের মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার গতি যেন বেশ মন্থরই। পুত্রসন্তান–কাঙ্ক্ষী সংসারে জন্ম নেওয়া অধিকাংশ কন্যাশিশু এখনো অবহেলার শিকার। অসচ্ছল পরিবারগুলোতে তারা হয়ে ওঠে বোঝা। কিছু ব্যতিক্রম বাদে, ‘কন্যাসন্তান পরিবারের জন্য অভিশাপ’ – সমাজের এমন ধারণা এখনো বদলায়নি। এর দায় প্রথমত পরিবারের। সমাজের বিভিন্ন ট্যাবুর কারণে বাবা–মা থেকে শুরু হয় পুত্র–কন্যার মধ্যে পার্থক্য করা। ভালো স্কুলে পড়ানো কিংবা উৎসবে ভালো পোশাক, এসবে গুরুত্ব পায় ছেলেরা। একুশ শতকে এসেও কন্যাকে যে পর্যন্ত বিয়ে না দেওয়া হচ্ছে, সে পর্যন্ত যেন মা–বাবার স্বস্তি নেই। এ যেন বিশাল দায়, পাথরভার সম! এটুকুই নয়, এ সমাজে আজও ‘বাবার বাড়ির’ সম্পদে শতভাগ অধিকার পুত্রের। সেখানে কন্যারা করুণারই পাত্র হয়ে আছে। আইনকানুন সবই এখানে হেরে যায় শুধু পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে। শুধু পুরুষ মস্তিষ্কই যে এমন চিন্তার উৎস, এমনটা নয়। নারীরাও এ ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিকতার পালে হাওয়া যোগাচ্ছেন। প্রায়ই দেখা যায়, যেখানে মায়েদের তার মেয়ের অধিকার নিয়ে কথা বলার কথা, সেখানে তিনি সমাজের শেখানো বুলিতে নিজের কন্যার বিপক্ষে অবস্থান নেন। এ ক্ষেত্রেও কারণ কিন্তু সেই পুরুষতন্ত্র। পুত্রই পরিবারের কর্তা হয়ে উঠবে, আর মেয়ে যাবে অন্য পুরুষের বাড়ি।
অথচ অর্থনীতি কিংবা জননীতির বিভিন্ন সূচকে আমরা জানতে পাই যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের ক্ষমতায়ন বেড়েছে! অর্থনীতিতে তাদের অবদান আগের তুলনায় বেশি। সবই ঠিক আছে। কিন্তু সমাজের মননে, মানসিকতায় কতটা এগিয়েছে সূচক? এখনো সেই আদিম অন্ধকারেই পড়ে আছি আমরা। সবকিছুই বাড়ছে, উন্নয়ন হচ্ছে, কেবল উন্নয়ন ঘটছে না কন্যার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার, কন্যাকে মেনে নেওয়ার প্রবণতায়। এহেন পরিস্থিততিতে তাই আমরা সোচ্চার কণ্ঠে বলতে চাই, কন্যা–শিশু সুরক্ষা পেলে ধীরে ধীরে নারীর প্রতি চলমান যে বৈষম্য এখনো সমাজে দুষ্ট ফোঁড়ার মতো কষ্ট দিচ্ছে তা দূর হবে। সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে ইতোমধ্যে কন্যা–শিশুদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে নেওয়া হয়েছে কঠোর আইন। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। কিন্তু কন্যা–শিশুর সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও রয়ে গেছে প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায়। আইন প্রণয়ন–পালনের পাশাপাশি এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হতে হবে কন্যা–শিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। আর কন্যা–শিশুর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে পরিবারের পুরুষ সদস্যকেই। আমরা চাই কেবল কাগুজে প্রতিপাদ্য বিষয় হিসাবেই নয়, আগামীর বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই কন্যাশিশুর স্বপ্নে গড়ে উঠুক।