পুরনো যন্ত্রাংশ, ব্র্যান্ডহীন বাতি ও তারে ১০ সড়কে আলোকায়ন

তদন্ত প্রতিবেদন : দায় ঠিকাদারও চসিক প্রকৌশলীর । হিলভিউ আবাসিক এলাকা

মোরশেদ তালুকদার | শনিবার , ২১ জুন, ২০২৫ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

নগরের হিলভিউ আবাসিক এলাকার ১০টি সড়ক আলোকায়নে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) গৃহীত একটি প্রকল্পের ‘বি ও কিইউ’তে (বিল অব কোয়ানটিটি) যে পরিমাণ মালমাল ধরা ছিল বাস্তবে তার চেয়ে কম স্থাপন করা হয়েছে। এমনকি শিডিউল বহির্ভূতভাবে প্রস্তাবিত ব্র্যান্ডের বাতির পরিবর্তে ‘অখ্যাত’ ব্র্যান্ডের বাতি লাগানো হয়। স্থাপিত তারও ছিল ব্র্যান্ডহীন। এছাড়া স্থাপিত দুই ধরনের যন্ত্রাংশ ছিল পুরনো।

প্রকল্পটিতে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর তা তদন্তে চসিকের গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এসব ‘অনিয়ম’এর চিত্র উঠে আসে। প্রতিবেদনে কাজের প্রতিটি আইটেমের পরিমাণ ও গুণগত মানের দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স মিশুক কন্সট্রাকশন’ এবং চসিকের বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেন সেলিমের ওপর বর্তায় বলে উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে গুণগত মান নিশ্চিত হওয়ার জন্য চুয়েট অথবা স্বনামধন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরীক্ষা করার সুপারিশ করা হয়।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের (২০২৪) ১১ জুলাই থেকে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে হিলভিউ আবাসিক এলাকার ১০টি সড়ক আলোকায়ন করার জন্য ‘মেসার্স মিশুক কন্সট্রাকশন’কে কার্র্যাদেশ প্রদান করে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে চুক্তিমূল্য ছিল ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। নিয়োগকৃত ঠিকাদার ‘মেসার্স মিশুক কন্সট্রাকশন’ কাজ সমাপ্ত হয়েছে উল্লেখ করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিল তৈরির জন্য ‘গোপনে’ নথি উপস্থাপন করেন বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সহকারী প্রকৌশলী। এরপর ২৫ জানুয়ারি চসিকের দুই বাতি পরিদর্শক মোহাম্মদ মহসিন ও বাসু বিশ্বাস এ বিষয়ে সংস্থার প্রধান নির্বাহী বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়ে প্রকল্পটিতে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করেন। এরপ্রেক্ষিতে ২৭ জানুয়ারি অভিযোগ তদন্তে চসিকের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবুল কাশেমকে দায়িত্ব দিয়ে অফিস আদেশ জারি করেন চসিক সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন। এর কিছুদিন পর বদলি হয়ে চলে যান তদন্ত কমকর্তা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবুল কাশেম। তবে সম্প্রতি তিনি তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণ করেন চসিকে।

এ বিষয়ে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। সুপারিশের আলোকে আমরা প্রযোজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

কী আছে প্রতিবেদনে : তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, চুক্তিপত্রের ‘বি ও কিইউ’তে (বিল অব কোয়ানটিটি) এলইডি স্ট্রিট লাইট ব্র্যান্ডের কিছু সুনির্দিষ্ট নাম ছিল। কিন্তু সরেজমিন পরিদর্শনকালে চুক্তিপত্রে উল্লেখিত ব্র্যান্ডের কোনো বাতি পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘স্থাপনকৃত বাতির গায়ে ব্র্যান্ড উল্লেখ না থাকায় সেগুলো অখ্যাত কোনো প্রস্তুতকারী কর্তৃক প্রস্তুত করা হয়েছে; যা সিডিউল বহির্ভূত প্রতীয়মান হয়। সরবরাহকৃত বৈদ্যুতিক তারেও কোনো ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ নেই’।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হিলভিউ আবাসিক এলাকার ১০টি রাস্তায় আলোকায়নের জন্য ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকায় মেসার্স মিশুক কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। সরবরাহকৃত কাজের প্রধান আইটেম ১০৫টি লাইটসহ পাইপ ব্রেকেট, ক্যাবলসহ আনুষাঙ্গিক মালামাল রয়েছে। সরবরাহকৃত মালামালগুলো এ সংক্রান্ত ‘গ্রহণ কমিটি’ কর্তৃক গ্রহণ করার পর কার্যস্থলে লাগানোর কথা। কিন্তু এখানে গ্রহণ কমিটি ছাড়াই মো. কামাল হোসেন সেলিম এককভাবে মালামালসমূহ গ্রহণ ও স্থাপন করেন বলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি তদন্ত কমিটিকে জানায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার বা সরবরাহকারীর নিকট হতে মালামালসমূহ বুঝে নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকর্মচারীদের জড়িত না করে মো. কামাল হোসেন সেলিম এককভাবে আলোচ্য কাজটি বাস্তবায়ন করেছেন; যা চাকুরি বিবি পরিপন্থি এবং স্বার্থের সংঘাত। তাছাড়া সরবরাহকৃত মালামালের পরিমাণ ও গুণগতমান কমিটি কর্তৃক যাচাই না করেই তিনি স্থাপন করেছেন। এতে দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার বা সরবরাহকারীও আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, স্থাপিত বিভিন্ন মালামালে বি ও কিইউ পরিমাণ অপেক্ষা কম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৫ আরএম ক্যাবল৪৫০০ মিটারের বিপরীতে ৩৯৭০ মিটার, জিআই পুল ব্রেকেট১০৫টি’র বিপরীতে ৯৪টি এবং স্পুল রেক১০৫টি’র বিপরীতে ৮৬টি স্থাপন করা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর প্রকল্প এলাকার পাঁচটি রাস্তা পরিদর্শন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এসময় পরিদর্শনকালে ৮১০টি বাতি বন্ধ পাওয়া যায় এবং কয়েকটি ‘পাইপ ব্রেকেট’ ও ‘স্পুলরেক’ পুরনো পাওয়া যায়। এ বিষয়ে প্রকৌশলী কামাল হোসেন সেলিমের কাছে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তাকে জানান, বন্ধ বাতিগুলো সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার পরিবর্তন করে দিবে। তবে পুরাতন মালামালের বিষয়ে কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি প্রকৌশলী সেলিম।

তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল কাশেম তার মতামতে উল্লেখ করেন, কাজের প্রতিটি আইটেমের পরিমাণ ও গুণগত মানের দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী মেসার্স মিশুক কন্সট্রাকশন এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী মো. কামাল হোসেন সেলিমের ওপর বর্তায়। এক্ষেত্রে বিল সুপারিশের পূর্বে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রকৌশলী এবং নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুুৎ) কর্তৃক চুক্তি এবং স্পেসিফিকেশন মোতাবেক মালামালসমূহের গুণগত মান নিশ্চিত হওয়ার জন্য চুয়েট অথবা স্বনামধন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরীক্ষা করে পুক্সখানুপুক্সখুভাবে যাচাই করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমুদ্রসীমার পরিপূর্ণ হাইড্রোগ্রাফিক তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় ডাকাতি করে পালাচ্ছিলেন, লোহাগাড়ায় ধরা