পুরোনো সেই ‘খোরাকি ভাতার’ দাবিতে নতুন করে আন্দোলনে নামছেন দেশের নৌযান শ্রমিকেরা। এতে করে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে আবার পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লাইটারেজ জাহাজ শ্রমিকদের একটি অংশ আগামী ১৯ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে সারাদেশে পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দেয়ার এ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সরকারি দল সমর্থিত নৌযান শ্রমিকদের অপর একটি বড় গ্রুপ ছয়টি পৃথক সংগঠন নতুন করে মোর্চা গঠন করেছে। আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে দাবি মেনে না নিলে ১৯ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে তারাও ধর্মঘটে যাবে। অপরদিকে লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে এসব দাবি–দাওয়াকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে নৌ যান শ্রমিকদের যে কোনো আন্দোলনে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের আমদানি বাণিজ্য। কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে বন্দরের বহির্নোঙরে। আগামী ২০ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া আান্দোলনেও চট্টগ্রাম বন্দরকেই জটিলতায় পড়তে হবে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর এবং ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের শিল্পখাতের জন্য আমদানি করা পণ্য বোঝাই বড় বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে প্রবেশ করতে পারে না। এক্ষেত্রে পঞ্চাশ হাজার টন থেকে এক লাখ টন পর্যন্ত পণ্য নিয়ে আসা অধিকাংশ জাহাজই বহির্নোঙরে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করে দিয়ে ফিরতি পথ ধরে। ২০ থেকে ২৫ হাজার টন পণ্য নিয়ে আসা জাহাজগুলো কিছু পণ্য বহির্নোঙরে খালাস করে। ড্রাফট কমিয়ে বন্দরের জেটিতে বাকি পণ্য খালাস করে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বর্তমানে বছরে নয়শ’রও বেশি মাদার ভ্যাসেলে অন্তত ছয় কোটি টন পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সিমেন্ট ক্লিংকারসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানার কাঁচামাল। এছাড়া বন্দরের ওভার সাইটেও বিপুল পরিমাণ পণ্য লাইটারেজ জাহাজে বোঝাই করে দেশের অন্তত ২৫টি স্থানে পরিবহন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর এবং বহির্নোঙর থেকে বন্দর চ্যানেলের নানা ঘাট এবং ঢাকা, মিরপুর, নগরবাড়ী, বাঘাবাড়ী, নোয়াপাড়া, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব জাহাজ পণ্য পরিবহন করে। চট্টগ্রামস্থ সিইউএফএল এবং কাফকোর উৎপাদিত সারের একটি অংশও বিসিআইসির নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন জেলার গুদামে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে প্রায় দেড় হাজার লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজের স্বাভাবিক চলাচলের উপর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরসহ দেশের পণ্য পরিবহন নেটওয়ার্ক পুরোপুরি নির্ভর করে। নির্ভর করে বহির্নোঙরের জট পরিস্থিতি। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য সময়মতো খালাস করা না গেলে বহির্নোঙরে জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে জট সৃষ্টি হয়। এতে করে লাইটারেজ জাহাজের চলাচলের উপর বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বহুলাংশে নির্ভর করে।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর নানাভাবে সংকট মোকাবেলা করেছে। বৈশ্বিক মহামারী ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সাগর উত্তাল হয়ে ওঠাসহ বিভিন্ন কারণে বিঘ্ন ঘটেছে বন্দরের বহির্নোঙরের কর্মকাণ্ডে। এরইমধ্যে লাইটারেজ শ্রমিকদের পুরোনো দাবিকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বন্দর আবারো নতুন করে সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, লাইটারেজ শ্রমিকদের বেতন ভাতা নিয়ে বিভিন্ন সময় আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। আলোচনাও হয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত নিয়মে জাহাজ মালিকেরা প্রতিটি জাহাজের শ্রমিকদের খোরাকি ভাতা (মাসের খাদ্য ভাতা বাবদ বেতনের একটি অংশ) মাসের শুরুতেই অগ্রিম প্রদান করেন। মাস শেষে এই টাকা বেতনের সাথে সমন্বয় করা হয়। কিন্তু শ্রমিকেরা অগ্রিম নেয়া অর্থ বেতনের সাথে সমন্বয় না করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন বহুদিন ধরে। তারা বেতনের বাইরে আলাদা খাদ্য ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে ইতোপূর্বেও আন্দোলন করেছেন।
বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাদাত হোসেন দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর এসব দাবি দাওয়া নিয়ে আমরা ধর্মঘট করেছিলাম। ওই সময় মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে খাদ্য ভাতার দাবিটি মেনে নেয়া হয়। বলা হয়েছিল– ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে এই দাবি কার্যকর করা হবে। অন্যান্য দাবিও ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করার কথা লিখিতভাবে বলা হয়েছিল। কিন্তু এবছর মার্চ থেকে আমাদের দাবি বাস্তবায়ন করা হয়নি। করোনা মহামারীর কারণে আমরাও বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনে যাইনি। কিন্তু মাসের পর মাস গেলেও জাহাজ মালিকেরা আমাদের দাবি মেনে নিচ্ছেন না। খোরাকি ভাতা না দিয়ে বেতনের সাথে সমন্বয় করা হচ্ছে। এই অবস্থায় আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করে সৈয়দ শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন আগামী ১৯ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।’
তিনি বলেন, আমরা সরকার সমর্থিত জাতীয় শ্রমিক লীগের আওতাধীন ছয়টি শ্রমিক সংগঠন একজোট হয়ে একটি মোর্চা গঠন করেছি। নৌ শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামে আমাদের এই মোর্চার ব্যানারে আমরা ইতোমধ্যে মানববন্ধন করেছি। আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত দাবি মেনে নেয়ার সময় দিয়েছি। এরমধ্যে দাবি মেনে নেয়া না হলে ১৯ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে আমরাও ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘোষণা করবো। সরকার সমর্থিত ছয়টি শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ নৌ যান শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ নৌ যান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন, বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার ভলগেট শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ট্রলার ভলগেট শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ জাহাজী শ্রমিক ফেডারেশন যৌথভাবে মোর্চা গঠন করেছে বলেও সৈয়দ শাহাদাত হোসেন দৈনিক আজাদীকে জানান।
লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে এই দাবি নাকচ করে দিয়ে বলা হয়েছে মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মালিক এবং শ্রমিকদের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছিল তাতে বলা হয়েছে, বেতন নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয় সুনির্দিষ্ট করে গেজেট প্রকাশের পাঁচ বছরের মধ্যে আর কোনো দাবি দাওয়া উত্থাপন করা হবে না। কিন্তু গেজেট প্রকাশের দুই বছর পার হওয়ার আগেই খোরাকি ভাতার নামে দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করা হয়েছে। এটি সরকারের সাথে আলোচনা এবং মন্ত্রণালয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। তাই এই দাবি নিয়ে আলোচনা করারও প্রশ্ন উঠে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জাহাজ মালিক বলেছেন, শ্রমিকেরা ধর্মঘট করলে দেশের নৌ পরিবহন সেক্টরই মুখ থুবড়ে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমদানি বাণিজ্য। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর। অবশ্যই সরকার বিষয়টি দেখবে। আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করবো বলেও তারা জানান। তিনি বলেন, মাসের পর মাস নদীতে অলস ভাসছে আমাদের জাহাজ। প্রতিটি জাহাজই লাখ লাখ টাকা লোকসান দিচ্ছে প্রতি মাসে। কোনো ভাড়া নেই। বৈশ্বিক মহামারীতে যেখানে পুরো পৃথিবী থমকে আছে। মানুষ কোনো রকমে জীবন ধারণ করার চেষ্টা করছে। হাজার হাজার মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। ছাঁটাই চলছে। সেখানে খোরাকি ভাতার মতো ঠুনকো দাবি নিয়ে সরকারকে জিম্মি করার এই অপচেষ্টা নিশ্চয় সরকারই প্রতিহত করবে বলেও জাহাজ মালিকেরা মন্তব্য করেছেন। এই ব্যাপারে লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের প্রধান নির্বাহী মাহবুব রশিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এই ধরনের কর্মসূচির কথা শুনেছি। আমরা বিষয়টির উপর নজর রাখছি।’