রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ার মৃত্যু–সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে একটি গান ভাইরাল হয়–‘নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম/বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম।’ শিল্পী পাপিয়া সারোয়ার গানটি ‘কুসুমকলি’ সিনেমায় প্লে–ব্যাক করেছিলেন। গানটির কথা ও সুর করেছেন মনিরুজ্জামান মনির। সিনেমায় গানটি লিপসিং করেছেন সুচরিতা। গানটি শোনার সময়ে ‘পিয়ন’, ‘টেলিফোন’ ও ‘টেলিগ্রাম’ শব্দ ক’খানা করোটির ভেতরে অনুরণন সৃষ্টি করে। কত বছর পর আবার শব্দ তিনটি কানে বাজল।
কারো কাছে জরুরি বার্তা পাঠাতে ‘টেলিগ্রাম’ করা হতো। যেখানে টেলিফোনের সুযোগ ছিল না, ওখানে ‘টেলিগ্রাম’ করে জরুরি বার্তা প্রদান করা হতো। ‘টেলিগ্রাম’–এ মৃত্যু–সংবাদ আসত। সরাসরি মৃত্যুর কথা লেখা থাকত না, লিখত– ‘মাদার সিরিয়াস, কাম শার্প।’ গ্রামাঞ্চলে ‘টেলিগ্রাম’ আসার সংবাদে প্রাপকের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হতো। এই বুঝি কোনো খারাপ সংবাদ আসল। শুনেছি, অনেকে ছল–ছাতুরির কৌশল হিসেবে ‘টেলিগ্রাম’ করত। যেমন ছেলে বা স্বামী দূর দেশে চাকরি করেন। অনেকদিন বাড়ি–ঘরে আসে না। ‘মাদার সিরিয়াস, কাম শার্প’ লিখে ‘টেলিগ্রাম’ করা হতো। আবার অফিসে বস ছুটি না দিলে তখনও ভুয়া টেলিগ্রাম করিয়ে ছুটির ব্যবস্থা করত অনেক সুযোগসন্ধানী। কখনও ‘টেলিগ্রাম’ করেছি কিংবা পেয়েছি বলে মনে পরছে না।
‘পোস্টঅফিস’ আর ‘পিয়ন’–এর সঙ্গে সম্পর্কটা নিবিড় ছিল। জিপিও, সদরঘাট পোস্ট–অফিস, কানুনগোপাড়া পোস্ট–অফিসে তখন নিয়মিত যাতায়াত ছিল। প্রচুর চিঠি, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ডাকযোগে পেতাম। চিঠি লিখতাম অনেক। আশির দশকে ডাকযোগে বাইবেল শিক্ষার একটা কোর্স ছিল। ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে ঐ কোর্সে অংশগ্রহণ করেছি পুরস্কারের লোভে। কোর্স শেষে একটা বাইবেল আর একটা সার্টিফিকেট পেয়েছিলাম। চিঠি লেখার কৌশলটা শৈশবে আমার দাদু জ্যোতিষচন্দ্র বলের কাছে শিখেছি। ৮৫ বছর বয়সে দাদু আমাকে মুখে–মুখে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি লিখিয়েছিলেন। সাদা–কাগজ কেটে গরম ভাত দিয়ে খাম বানিয়ে ডাক–টিকেট লাগিয়ে দেশ–বিদেশের আত্মীয়–স্বজনের কাছে চিঠি লিখেছি। তখন মাঝে–মাঝে সন্তোষী মায়ের নিদের্শ বলে বেনামী চিঠি পেতাম। চিঠিতে লেখা থাকত এটা পড়ে আরও দশজনকে হুবহু লিখে খবরটা প্রচার করবে। না–হলে তোমার মহাবিপদ হবে। ভয়ে আত্মীয়–স্বজনের ঠিকানা যোগার করে দশটা চিঠি হুবহু লিখে পোস্ট করেছি। হাতের লেখা দেখে আত্মীয়–স্বজনের অনেকেই বুঝে যেতেন।
চিঠি শুধু আত্মীয়–স্বজনের কাছে লিখিনি। অনেক কবি–সাহিত্যিক–সাংস্কৃতিকজন–নাট্যজন–গুনীজনের কাছেও লিখেছি। তাঁরাও জবাব দিয়েছেন। সে–সব চিঠি এখনও আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।
তখন পত্র–মিতালীর একটি রেওয়াজ ছিল। পেনফ্রেন্ড ছিল অনেক। এদের সঙ্গে পত্র–যোগাযোগ ছিল। নিয়মিত চিঠি লিখতাম। সামনা–সামনি কোনোদিন দেখা হয়নি। আমার ছাত্রজীবনের এক পেনফ্রেন্ডের সঙ্গে প্রায় চারদশক পর শেরপুরে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাক্ষাৎ পেয়েছি। একসময় নিয়মিত পত্র–যোগাযোগ ছিল। এর আগে সামনা–সামনি কোনোদিন দেখা হয়নি। একজন পেনফ্রেন্ড এক দুর্গাপূজায় আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। কয়েকদিন ছিলেন। তখন পত্রমিতালী একটি জনপ্রিয় সখ ছিল। পত্রমিতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সাপ্তাহিক বিচিত্রাসহ অনেক ম্যাগাজিনে নাম–ঠিকানা টাকা দিয়ে ছাপিয়েছি। এসব বিজ্ঞাপনে শব্দ গুনে বিল নিত।
পত্রিকা অফিসে লেখা পাঠাতাম ডাকযোগে। শহরে বসবাস করেও দৈনিক আজাদী, দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় ডাকযোগে লেখা পাঠিয়েছি। লেখালেখির প্রথম জীবনে পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদকের কাছে বেশিরভাগ সময়ে ভয়ে ও লজ্জায় সরাসরি বা হাতে–হাতে লেখা জমা দিইনি। এ–কাজটা অবশ্য আমি এখনও করি না। পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদকদের সঙ্গে এখনও সাক্ষাৎ যোগাযোগ নেই। ছাত্রাবস্থায় বেশ কিছুদিন সখের সাংবাদিকতা করেছি। থানা পরবতীকালে উপজেলা সংবাদদাতা হিসেবে ডাকযোগে খবরাখবর পাঠাতাম। ডাকযোগে সে–সব পত্র–পত্রিকার সৌজন্যকপি আসত। মুদ্রিত সংবাদসমূহ যত্নসহকারে সংরক্ষণ করেছি। ডাকযোগে পত্রিকার চিঠিপত্র কলামেও লেখা পাঠিয়েছি। দৈনিক সংবাদের চিঠিপত্র কলাম ছিল খুবই সমৃদ্ধ। প্রয়াত বর্ষিয়ান সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত এটা সম্পাদনা করতেন।
‘পোস্টঅফিস’ আর ‘পিয়ন’–এর কথা উঠলে সুকান্তের রানার কবিতা মনে পড়ে— ‘ রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে/ রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে…’। কবিতাটির প্রিয় কয়েকটি লাইন অনেক লেখাতে একসময় কোড করেছি-‘এমনি ক’রেই জীবনের বহু বছরকে পিছে ফেলে,/পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে’/ক্লান্তশ্বাস ছুয়েছে আকাশ মাটি ভিজে গেছে ঘামে/ জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।/অনেক দুঃখে, বহু বেদনায় অভিমানে অনুরাগে,/ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।’ সুকান্তের মতো আমাদেরও প্রশ্ন ছিল–‘ এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?/রাত শেষ হ’য়ে সূর্য উঠবে কবে?’ রানার সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত মুখ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে শুনলে শরীরে এখনও রক্ত টকবগিয়ে ওঠে। একই–সঙ্গে স্মরণে আনতে হয়, স্মৃতির শহর চট্টগ্রামে নৃত্যগুরু রুনু বিশ্বাসের নৃত্য। চোখের সামনে রানারকে দু’জনেই জীবন্ত করে তুলেছিলেন। কালের পরিক্রমায় ‘পোস্ট–অফিস’ আর ‘পিয়ন’–এর সঙ্গে সংযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে আমার ছোটবোনের নামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি প্রাপ্তির সুবাদে বাড়িতে সর্বশেষ ডাকযোগে চিঠি এসেছিল, তাও প্রায় একদশক আগে। এরও অনেক আগে ‘পোস্ট–অফিস’ আর ‘পিয়ন’–এর সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পোস্ট–অফিসে যাতায়াত না থাকায় ছোটবোনের চিঠিটা পোস্ট–অফিসে পড়েছিল। স–হৃদয় পোস্ট–মাস্টারের আন্তরিক উদ্যোগের কারণে অনেকদিন পর চিঠিটা আমরা পেয়েছিলাম। এখনও কি আগের মতো ‘পিয়ন’ আছে? এখনও কি ‘পিয়ন’ আগের মতো বাড়ি–বাড়ি গিয়ে চিঠি পৌঁছে দেয়? মনে হয়, এখন সে–ই ‘লাল–ডাকবাক্স’ স্থান পেয়েছে যাদুঘরে।
টেলিফোন অর্থ্যাৎ লেন্ডফোনের অবস্থাও এমন হতে চলেছে। সত্তর–আশির দশক এমনকী নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত লেন্ডফোন ছিল সোনার হরিণের মতো। অফিস–আদালতের বাইরে উচ্চবিত্ত, উচ্চ–মধ্যবিত্তের বাড়ির ড্রয়িংরুমে টেলিফোন শোভা পেত। কারো–কারো বেডরুমে থাকত। সৌখিন–জনের বাড়িতে একাধিক সেট থাকত। ওটাকে প্যারালাল লাইন বলা হতো। আমাদের কোনো টেলিফোন ছিল না। টেলিফোনের যোগাযোগও তেমন ছিল না। বাবা অফিসের কাজে ঢাকা গেলে মাঝে–মধ্যে সামনের বাসায় ফোন করতেন। ওখানে গিয়ে কথা বলতাম। বোধন আবৃত্তি পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হলে টেলিফোনে যোগাযোগটা বেড়ে গেল। রণজিৎ কাকু–নাজমা–রবিদা পারভেজের অফিসে টেলিফোন ছিল। এর মাধ্যমে ঢাকা–কোলকাতার বাচিকশিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। বোধন আবৃত্তি স্কুলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন সময়ে বাকের–ভাইখ্যাত আসাদুজ্জামান নূরের আগমন নিশ্চিত করতে প্রয়াত হাসান আরিফের সঙ্গে আমি আর পারভেজ তিন জায়গায় বসে কনফারেন্স করেছি। ফোনটা আমিই করেছিলাম পারভেজকে চেরাগীর পাশে একটা কুলিং কর্ণার থেকে। ওখান থেকে টাকা দিয়ে ফোন করা যেত। পারভেজ আরেকটা ফোন থেকে আরিফ ভাইকে ফোন করে দু’টো ফোনের রিসিভার উল্টো করে ধরে সে–ই কনফারেন্সের ব্যবস্থা করেছিল। পুরো ব্যাপারটা পারভেজের ক্যারিসমেটিক কারণে সম্ভব হয়েছিল। তখন ফোন–কল সেন্টার ছিল। টাকা দিলে ফোন করা যেত। নিউমার্কেটে এমন কল–সেন্টার ছিল। এর কিছুদিন পর আরেকটু আধুনিকায়ন হয়। স্থানে–স্থানে টেলিফোন বক্স বসল। বক্সে কয়েন দিলে ডায়াল করা যেত। এমন ফোন জিপিও, নিউমার্কেট, রেল–স্টেশন, মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেকস্থানে ছিল। ফোন করার সুযোগ বেড়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিফোন বুথ স্থাপনের পর অনেকে নাকি নারীকন্ঠ শোনার জন্য অজানা নম্বর ডায়াল করতেন। সংযোগ না হলে ‘সংযোগ দেওয়া সম্ভব না’ বা ‘এটা কোনো গ্রাহকের নম্বর না’ বা ‘নম্বরটি ব্যস্ত আছে’ এমন সব স্বয়ংক্রিয় নির্দেশনা আসত। এ–সব কন্ঠস্বর যে রেকর্ডকৃত, তা অনেকেরই জানা ছিল না।
নন্দন যখন করলাম, ল্যান্ডফোনের একটা নম্বর পেয়েছিলাম অন–রিকোয়েস্টে। নন্দন–এর অন্যতম অংশীদার তপন মিত্রের ছিল নম্বরটা। নন্দনে নিয়মিত বসতাম, তপনদার অনেক ফোন আসত। অনেকবার রিসিভ করে বিব্রত হয়েছি। ল্যান্ডফোনে অনেক ভুল নম্বরের ফোন আসত। ভুল নম্বর নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত ছিল। কোনোটা নাকি সত্যিও ছিল। আমাদের কাছে সে–সময় ফোন করার চেয়ে ফোন আসাটা গৌরবের ছিল। ল্যান্ডফোনে কাউকে একবার ডায়াল করে পাওয়া যেত কম। লাইন–বিজি দেখাত। রিসিভার যিনি, তিনি অন্য নম্বরে কথা না বললেও বিজি টোন আসত। আবার ফোনের রিসিভার ঠিক মতো রাখা না থাকলেও বিজি টোন আসত। টেকনিশিয়ানদের নানান ক্যারিশমেটিক কারণেও ঠিকমতো লাইন পাওয়া যেত না। উপরি অর্থ পেতে নাকি তারা এসব করত। ফোনের বিল বেশি ছিল না। কিন্তু একটা ল্যান্ডফোনের পার্মিশন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিল, ব্যয়–সাপেক্ষও ছিল; অনেকটা আজকালকার বিদ্যুৎ–গ্যাস লাইনের মতো।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মোবাইল ফোন সহজতর হলে যোগাযোগ দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটে যায়। সে–ই বিপ্লবটা নিজের চোখে দেখলাম।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার