চট্টগ্রাম শহরে প্রতিনিয়ত পাহাড় কাটা হচ্ছে। দৈনিক আজাদীতে ২৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বলা যায়, আগে পাহাড় কাটা হতো রাতে, এখন দিনেও কাটে। খবরে প্রকাশ, পাহাড়খেকোদের ব্যাপারে এমন মন্তব্য করেছেন স্থানীয়রা। তাঁরা বলেছেন, অনেকদিন ধরে এখানে পাহাড় কেটে নানা ধরনের ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। গত কিছুদিন ধরে বেশ লম্বা একটি রাস্তা বানানো হচ্ছে। ফৌজদারহাট–বায়েজিদ লিংক রোড থেকে ভাটিয়ারী–বড় দীঘির পাড় লিংক রোড পর্যন্ত আড়াআড়ি একটি রাস্তা তৈরি করার বৃহৎ এক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করেছে তারা। ইতোমধ্যে আধা কিলোমিটারেরও বেশি পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। বাকি অংশের পাহাড়ও রাতে দিনে কাটাকাটি চলছে। পাহাড় কেটে তৈরি করা রাস্তার দুই পাশের সরকারি–বেসরকারি জায়গা দখল করে বিক্রি করার মহোৎসব চলছে। পাহাড় কাটার এই কার্যক্রম আগে রাতে চললেও এখন দিনের বেলায়ও প্রকাশ্যে চলছে। সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হক একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে ২০১১ সালে ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা করেন। এতে বলা হয়, বেশির ভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝরনা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে। ১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করেন। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময়ে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে। এদিকে ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ন্যাচারাল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘এনভায়রনমেন্টাল ডিগরিডেশান থ্রো হিল কাটিং ইন চিটাগং ডিসট্রিক্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাকর্মটি হয় ২০০৫ সালে। এর নেতৃত্বে ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এম এ সাত্তার। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরের খুলশীতে সর্বোচ্চ ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং শহরতলির চৌধুরীহাট এলাকায় সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ পাহাড় কাটা হয়। ৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এসব পাহাড় কাটা হয়। নগর ও আশপাশের ২০০ পাহাড়ের মধ্যে প্রায় ১০০টি কেটে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে বলে গবেষণায় বলা হয়।
আজাদীর প্রতিবেদনটিতে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের অভিমত তুলে ধরা হয়েছে। তাঁরা বলেন, চার দশকে চট্টগ্রামের ১২০টি পাহাড় সাবাড় করে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় সাবাড় করা হচ্ছে। আমরা নানাভাবে দাবি জানিয়েছি, আন্দোলন করেছি, প্রেস কনফারেন্স করেছি। কিন্তু পাহাড় কাটা থামাতে পারিনি। রাতে দিনে পাহাড় কাটা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, জালালাবাদ এলাকায় বহু পাহাড় ছিল। সবই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে।
পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম নগরের মধ্যে এত দিনে যে সিংহভাগ পাহাড় ‘নাই’ করে দেওয়া হলো, তার দায় প্রধানত সিডিএ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর পড়ে। অন্য ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ ঠিক রেখে উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য যে সংস্থা নিয়োজিত, তারাই পাহাড় সাবাড় করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। উন্নয়নশীল দেশের রূঢ় বাস্তবতার কারণে কারখানা, রাস্তাঘাট দরকার। কিন্তু তা গড়তে গিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করলে চলে না। যে পাহাড়গুলো ধ্বংস করা হচ্ছে তার ক্ষতি জরিমানা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। স্বীকার্য যে প্রগতির রথ দ্রুত ধাবমান। কিন্তু তারও আগে স্বীকার করতে হবে, প্রকৃতিকে ভুলে উন্নয়ন হয় না।
তাই পাহাড় কাটা, পাহাড়ে বসতি এবং পাহাড়ধসের জন্য সংশ্লিষ্ট পাহাড়ের মালিককে দায়ী করা দরকার। যদি তা করা হয়, তাহলে পাহাড় রক্ষা হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর কেবল তদারকির দায়িত্বে থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাহাড়গ্রাসী লোভাতুর দখলদারদের মোকাবিলা করতে হবে শক্ত হাতে। কেননা পাহাড়খেকো–দুর্নীতিবাজদের শিকড় গভীর ও শক্তিশালী। এ সমাজে তাঁদের অবস্থান বড় মজবুত। এই জন্যই সচেতন মানুষ, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান–সংগঠন যতই উচ্চকণ্ঠ থাকুক না কেন, প্রতিদিন রাতের আঁধারে, প্রকাশ্য দিনের আলোয় নানাভাবে, নানা জায়গায় পাহাড় কাটা চলছেই। এ জন্য প্রশাসন তথা সরকারকে শক্ত হতে হবে। পাহাড় রক্ষা করা খুবই দরকার।