থেমে নেই পাহাড় কাটা। অবিরাম চলছে পাহাড় কাটার যজ্ঞ। পাহাড় কেটে ছোট্ট পরিসরেই গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি। অবৈধভাবে গড়ে উঠছে একের পর এক ঘর। এবিষয়ে প্রভাবশালীদের পাশাপাশি পরিবেশ অধিদফতরের লোকজনও কম দায়ী নয় বলে অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের। গত ৭ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নগরীর আকবর শাহ থানাধীন শাপলা আবাসিক এলাকার লইট্টা গোনা নামক স্থানে দিনে রাতে পাহাড় কাটা হচ্ছে। প্রায় একশ ফুট উঁচু একটি পাহাড়ের অর্ধেকেরও বেশি অংশ ইতোমধ্যে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। এই পাহাড়টি গত বেশ কিছুদিন ধরে কাটা হচ্ছে বলে জানিয়ে স্থানীয়রা বলেছেন, পাহাড় কাটার পাশাপাশি পাহাড়ে ধস সৃষ্টির জন্য মোটর লাগিয়ে রাতে দিনে পানি দেয়া হচ্ছে।
রাতে–দিনে কাটা হচ্ছে পাহাড়। আগে লুকোচুরি করে পাহাড় কাটা হলেও এখন প্রকাশ্যে কেটে ফেলা হচ্ছে। পাহাড়খেকোদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে শঙ্কিত সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে পাহাড়খেকোরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো সাবাড় হওয়ার শঙ্কা দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার মহোৎসব থামেনি। দিন কয়েক বন্ধ থাকলেও নতুন করে শুরু হয়েছে পাহাড় কাটা। ফৌজদারহাট–বায়েজিদ লিংক রোডের সন্নিহিত এলাকার পাহাড়গুলো অনেকদিন ধরে কাটা হচ্ছে। প্রভাবশালী একটি চক্র ফৌজদারহাট–বায়েজিদ লিংক রোড থেকে আড়াআড়িভাবে ভাটিয়ারী–বড়দীঘির পাড় লিংক রোড পর্যন্ত একটি রাস্তা করার জন্য পাহাড় কাটছে বেশ কিছুদিন ধরে। পাহাড় কাটার ব্যাপারে দৈনিক আজাদীতে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশের পর দিন দুয়েক বন্ধ ছিল অপতৎপরতা। পরিবেশ অধিদপ্তর বায়েজিদ বোস্তামী থানায় গিয়ে মামলা করেছিল। কিন্তু এরপর আর কিছু হয়নি। পাহাড়খেকো চক্রটি নতুন উদ্যমে পাহাড় কাটা শুরু করে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সভায় সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছিলেন, পাহাড় বেষ্টিত চট্টগ্রামে একশ্রেণির প্রভাবশালী রাতের অন্ধকারে পাহাড় কেটে বসতবাড়ি করছে। জলাশয় ভরাট এবং পাহাড় কাটা রোধে সংশ্লিষ্ট সকল ডিপার্টমেন্টকে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে।
এছাড়া সবুজ আন্দোলনের কর্মীরা চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা রোধে প্রয়োজন নাগরিকদের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি বলে উল্লেখ করেছেন। সাম্প্রতিক এক সভায় তাঁরা বলেন, দেশ স্বাধীনের পর থেকে সমাজের স্বার্থান্বেষী মানুষ আর সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে বিলুপ্ত হয়েছে চট্টগ্রামের প্রায় ১৩০টির অধিক পাহাড়। আধুনিক সভ্যতার আধুনিকায়নে চট্টগ্রামের পরিবেশ যেন এক গুমোট বাঁধা নৈরাজ্যের সাক্ষী। ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম উন্নয়নের মহাসড়কে থাকলেও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে তা এখন মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এজন্য দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। তাঁরা বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষায় সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকায় জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিডিএ সিটি কর্পোরেশন যার যার মত করে বিভিন্ন সময়ে অভিযান শুরু করে জরিমানার প্রক্রিয়া চালিয়ে আসলেও ফলশ্রুতিতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় কাটা রোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের জন্য ইতোপূর্বে জেলা প্রশাসকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দান করেছিলেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী। মন্ত্রী বলেছিলেন, এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে চলতি ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে দেশের বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ শতকরা ২০ ভাগে উন্নীত করার লক্ষ্যে বনায়ন ও বন সংরক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এ জন্য বনভূমি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ১৯২৭ সনের বন আইনের ৪ ও ৬ ধারায় প্রকাশিত গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে অন্তর্ভুক্ত এমন সকল বনভূমিকে ২০ ধারায় সংরক্ষিত বন ঘোষণার প্রক্রিয়া গ্রহণের লক্ষ্যে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে দ্রুত প্রস্তাব প্রেরণের জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা প্রদান করেন।
পরিবেশবিদ ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ– দিনের পর দিন পাহাড় কেটে নগরীতেও বসতি নামের মৃত্যুপুরী গড়ে তোলা হলেও তা নিয়ে পরিবেশ অধিদফতরের যেন কোন মাথা–ব্যথাই নেই। অথচ পাহাড় কাটা রোধ ও বিপন্ন হওয়া থেকে পরিবেশ রক্ষায় সরকারের আইনগত প্রতিষ্ঠান এটি। কিন্তু চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদফতর যেন ঘুমিয়েই থাকে সারাবছর। যতক্ষণ তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে অভিযোগ না আসে কিংবা গণমাধ্যমে রিপোর্ট না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকাশ্যে পাহাড় কাটার ধূম চললেও তাদের তেমন পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। যদিও এ অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি পরিবেশ অধিদফতরের। পাহাড় কাটা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারার নেপথ্যে পরিবেশ অধিদফতরের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতাকেই বড় করে দেখেন পরিবেশবিদরা। তাঁরা বলেন, ক্ষমতাশালী লোক যদি পাহাড় কাটে তাহলে অধিদফতরের কতটুকুইবা করার মতো থাকে। তাই অধিদফতরের পদক্ষেপকে ছোট করে দেখাটা ঠিক হবে না।