পাহাড়ে স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল, কুসংস্কার বাড়াচ্ছে ঝুঁকি

‘প্রত্যন্ত এলাকায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো না গেলে মানুষ কবিরাজের কাছেই যাবে’

প্রান্ত রনি, রাঙামাটি | রবিবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

সাম্প্রতিক সময়ে রাঙামাটির বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়নের দুর্গম চান্দবীঘাট পাড়ায় বাবামেয়েসহ ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে অজ্ঞাত রোগে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছিল পাহাড়ে। গ্রামের পুরাতন একটি গাছ কাটার ফলে ভূতে ভর করেছে বলে ধারণা করেছিল স্থানীয়রা। কাকতালীয়ভাবে গাছ কাটার পরবর্তী তিন মাসে গ্রামের পাঁচজন মানুষের মৃত্যুকে ঘিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অজ্ঞাত রোগে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ মারা যাচ্ছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে।

এ ঘটনার পর স্বাস্থ্য বিভাগের একটি চিকিৎসক দল যায় চান্দবীঘাটে। রোগের লক্ষণ দেখে জানা যায়, ৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল স্বাভাবিক রোগে। অথচ সরকারি চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে থাকা গ্রামের মানুষ ছুটে গিয়েছিল স্থানীয় বৈদ্যকবিরাজের কাছে।

ওই সময় চান্দবীঘাট পাড়া থেকে ফিরে এসে মেডিকেল টিমের প্রধান বরকল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মংক্যছিং মারমা সাগর জানিয়েছিলেন, যারা মারা গেছেন তারা স্বাভাবিক রোগেই মারা গেছেন। তাদের কারো লিভার, কিডনি ও প্যারালাইসিসজনিত জটিলতা ছিল। আর যারা তখন অসুস্থ ছিলেন তারাও সর্দি, কাশি, জ্বর নিয়ে ভুগছিলেন। গ্রামের মানুষ বৈদ্য দিয়ে কবিরাজি চিকিৎসা করে লতাপাতা সিদ্ধ করে খাওয়ানোর ফলে এই সমস্যায় পড়েছিল। কবিরাজ অনেককে খেতেও দেননি। শুধু বরকলের চান্দবীঘাট নয়, রাঙামাটির দুর্গম উপজেলাগুলোয় প্রতি বছর পানিবাহিত রোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের খবর পাওয়া যায়। বিশেষত জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়ন, জুরাছড়ির দুমদুম্যা ও মৈদং ইউনিয়ন এবং বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের বাসিন্দারা ডায়রিয়াসহ অন্য পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। ওইসব এলাকায় সুপেয় পানির সংকট থাকে বছর জুড়ে। গ্রামের মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলেও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গম এলাকার বাসিন্দারা উপজেলা সদরে এসে চিকিৎসা নিতে না পারায় অসুস্থ হয়ে মারা যায়। প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও কুসংস্কারের কারণে অনেকে সরকারি চিকিৎসা কিংবা টিকা গ্রহণ করতে চায় না। কুসংস্কারের ফলে টিকাভীতিসহ নানা কারণে এসব এলাকার মানুষ চিকিৎসাসেবার বাইরে রয়েছে। পাহাড়ে উপজেলা পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও সেগুলার দূরত্ব বেশি হওয়ায় স্থানীয়রা চিকিৎসাসেবা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।

জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, প্রতি বছরই রাঙামাটিসহ তিন পাহাড়ি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ ডায়রিয়া, পানিবাহিত, মশাবাহিতসহ বিভিন্ন রোগে মারা যায়। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ কুসংস্কারের কারণে বৈদ্যকবিরাজের কাছে যায়। এতে করে সাধারণ রোগে অসুস্থ হয়েও চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে পাহাড়ের মানুষ। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলা ম্যালেরিয়ার রেড জোন বা হটস্পট হিসেবে পরিচিত। তবে ২০১৭২৩ সাল পর্যন্ত রাঙামাটিতে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে কারো মৃত্যু হয়নি। কিন্তু রাঙামাটি জেলায় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর ৯০ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে সীমান্ত এলাকায়। ভারত সীমান্তবর্তী রাঙামাটির চার উপজেলা বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল ও বাঘাইছড়িতে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত মোট রোগীর ৯০ শতাংশ পাওয়া যায়। শহুরাঞ্চলে মশার জীবাণু ধ্বংস কার্যক্রম অনেকটা এগিয়ে থাকলেও দুর্গম ও সীমান্তবর্তী এলাকায় এই কার্যক্রম তেমন না থাকা এবং ঘন জঙ্গলের কারণে ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির রাঙামাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সার্ভিল্যান্স মেডিকেল অফিসার ডা. এন্ড্রু বিশ্বাস জানান, শহর এলাকায় মশা ও মশার জীবাণু নির্মূলে কার্যক্রম থাকলেও সীমান্তবর্তী এলাকায় সেটি নেই। যে কারণে গহিন জঙ্গল ও অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার কারণে মশার বিস্তার বেড়ে চলেছে।

চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির সাজেক ইউনিয়নে শিয়ালদহলুই মৌজায় দুটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের গোলাগুলিতে রোমিও ত্রিপুরা নামে ৭ বছরের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। তখন গ্রামের বাসিন্দারা দীর্ঘ ৭৮ ঘণ্টা বাঁশের সাহায্যে শিশুটিকে কাঁধে নিয়ে সাজেকের কংলাকে পৌঁছান। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে চট্টগ্রামে নেওয়া হয় শিশুটিকে। সেই শিশুকে প্রাণে বাঁচলেও সাজেকের মতো প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামের মানুষ মারা যাচ্ছে চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার কারণে।

পাহাড়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. প্রবীর খিয়াং আজাদীকে বলেন, পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্গম এলাকার মানুষের মৃত্যুর কারণ ভুল চিকিৎসা, নয়তো কুসংস্কার। এখন দেখবেন প্রান্তিক এলাকাগুলোর মানুষ রোগ মুক্তির প্রত্যাশায় নদীর পারে পূজা দেয়, বৈদ্য কবিরাজের দ্বারস্থ হয়। ভুল চিকিৎসার কারণে পাহাড়ের প্রান্তিক এলাকার মানুষ মারা যাচ্ছে। পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো না গেলে সাধারণত বৈদ্য কবিরাজের কাছেই যাবে। এতে করে চিকিৎসার অভাব ও ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু বাড়বে।

রাঙামাটির সিভিল সার্জন ডা. নীহার রঞ্জন নন্দী জানান, সাম্প্রতিক সময়ে রাঙামাটির বরকল উপজেলার ভূষণছড়ি চান্দবীঘাট পাড়ায় ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিক রোগে। আমাদের মেডিকেল টিম সেখানে গিয়ে স্থানীয়দের চিকিৎসা দিয়েছে এবং দেখেছে কবিরাজি চিকিৎসার কারণে অনেকে নিয়মিত না খেতে পেরে দুর্বল হয়ে গেছে। গ্রামের গাছ কাটার কারণে ভূত ভর করেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। পাহাড়ে এখনো মানুষ কুসংস্কারে বিশ্বাসী। স্বাস্থ্যসেবায় অপ্রতুলতার কারণে সবখানে চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো যায়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ
পরবর্তী নিবন্ধবিআইটিআইডি হাসপাতালে পানি নেই দুই সপ্তাহ