পার্বত্য চট্টগ্রামে বিলুপ্তির পথে সাম্বার হরিণ

প্রান্ত রনি, রাঙামাটি | রবিবার , ২৯ জুন, ২০২৫ at ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বনাঞ্চলে সাম্বার হরিণের দেখা মিললেও বাংলাদেশে এটি বিলুপ্তপ্রায় একটি প্রজাতির হরিণ। তবে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির সাম্বার হরিণের দেখা মিলছে। পাহাড়ের বনে এখনো টিকে থাকা সাম্বার অনেকটা সংকটাপন্নভাবে রয়েছে। আবাসস্থল ধ্বংস, স্থানীয়দের হরিণ শিকার, মাংস ভক্ষণ, হরিণের গায়ের চামড়ার বাণিজ্যিক চাহিদা থাকায় চোরা কারবারিদের শিকারের মুখে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংকটাপন্ন সাম্বার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১০ মে রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলার দুর্গম লুলাংছড়ি গ্রাম থেকে একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির একটি সাম্বার হরিণ শাবক উদ্ধার করে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ। পরে উদ্ধার করা এই সাম্বার হরিণ বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে স্থানান্তর করে বন বিভাগ। মূলত বন বিভাগের উদ্ধারের আগের দিন ৯ মে জুরাছড়ি উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী একটি দুর্গম গ্রামের বাসিন্দারা সাম্বার হরিণটি ধরে ফেলেন। পরে বন বিভাগ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে হরিণ শাবকটি উদ্ধার করে এবং যারা হরিণটি ধরেন তাদেরকে ১০ হাজার টাকা অর্থ সহায়তাও দেয়।

২০২৪ সালের ৭ মার্চ রাঙামাটির লংগদু উপজেলার ভাসান্যদম ইউনিয়নে মো. সাইদুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি একটি সাম্বার হরিণ ধরে মাংস বিক্রির জন্য জবাই করে। তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের রাঙ্গিপাড়া বিটের বন কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে সাইদুল ইসলামকে আটক করে এবং হরিণের ২৫ কেজি কাটা মাংস, মাথাচামড়াসহ দেহের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সাইদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২এর ৩৭ ধারায় মামলা দায়ের হয়।

সবশেষ গত শুক্রবার রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী নদী থেকে একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির সাস্বার হরিণ উদ্ধার করে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ। দুপুর ২টার দিকে বিলুপ্তপ্রায় সাম্বার হরিণটি উদ্ধার করা হলেও বিকেলে ৫টার দিকে হরিণটি মারা যায়। মারা যাওয়া সাম্বার হরিণটির ওজন প্রায় ১০০ কেজি এবং উচ্চতা আনুমানিক ৪ ফুট বলে জানিয়েছেন বন কর্মকর্তারা। ২০২১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত তিনটি ঘটনার মধ্যে একটি হরিণকে বাঁচানো গেলেও দুইটি হরিণ প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়েছে।

শুক্রবার কাপ্তাইয়ে সাম্বার হরিণ মারা যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের কাপ্তাই রেঞ্জ কর্মকর্তা ওমর ফারুক স্বাধীন জানান, কাপ্তাই বিপিডিবির ব্রিকফিল্ড এলাকার উত্তর পাশে গহীন জঙ্গলে কেউ কিংবা কোনো প্রাণী হরিণটিকে শিকার করার জন্য ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে হরিণটি বাঁচার জন্য এসে বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্প্রিলওয়ে সংলগ্ন নদীতে ঝাঁপ দেয়। তাৎক্ষনিক খবর পাওয়ার পর হরিণটিকে উদ্ধার করা হয়েছে। হরিণটি আহত অবস্থায় ছিল। পরে বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে।

দক্ষিণ বন বিভাগের কর্ণফুলী রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো. আবু কাউসার জানান, আমরা ধারণা করছি বন্য কুকুরের হাত থেকে বাঁচার জন্য হরিণটি পাহাড় থেকে কর্ণফুলী নদীতে ঝাঁপ দেয়। ওই সময় হরিণটি পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। পরে উদ্ধার করে হরিণটি কাপ্তাই রেঞ্জ কার্যালয়ে এনে একজন প্রাণী চিকিৎসক দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে পরবর্তীতে স্ট্রোক করে হরিণটি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর হরিণের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে বলছেন তিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জেলা রাঙামাটির কাপ্তাই, বিলাইছড়ি ও বাঘাইছড়ি উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিলুপ্তপ্রায় সাম্বার ও মায়া হরিণের উপস্থিতি রয়েছে। তবে স্থানীয়দের হরিণ শিকার, মাংস ভক্ষণ ও চোরা শিকারিদের উৎপাতে বিলুপ্তির পথে হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। বিভিন্ন সময়ে খাদ্যের খোঁজে বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে নেমে আসে। বনপ্রাণী গবেষকরা বলছেন, রাঙামাটির বিলাইছড়ির উপজেলার রাইংক্ষ্যং সংরক্ষিত বন, কাপ্তাই উপজেলার সীতা পাহাড়, রাম পাহাড়, কর্ণফুলী রেঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সংকটাপন্ন সাম্বার হরিণ দেখা যায়। এছাড়া বাঘাইছড়ি উপজেলার কাচালং সংরক্ষিত বনেও সাম্বার ও মায়া হরিণের উপস্থিতি রয়েছে। দেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ও নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলার হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপেও চিত্রা ও মায়া হরিণ রয়েছে। আগে সিলেট অঞ্চলে থাকলেও এখন কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্বার হরিণের অস্তিত্ব রয়েছে। এরমধ্যে সাম্বার হরিণ এখন বিলুপ্তির পথে, সংকটাপন্ন একটি প্রজাতি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান আজাদীকে বলেন, সুন্দরবন আর নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপে সাম্বার হরিণ কখনোই ছিল না। সাম্বার হরিণ মূলত পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বিচরণ করে থাকে। এক সময় সিলেট অঞ্চলে সাম্বারের উপস্থিতি ছিল, তবে সামপ্রতিক সময়ে ওই অঞ্চলে সাম্বার হরিণ দেখার কোনো রেকর্ড নেই। কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে কিছু সাম্বার হরিণ টিকে আছে। কিন্তু বিগত সময়ে শিকার, আবাসস্থল নষ্টসহ নানান কারণে বন্যপ্রাণীটি সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। সাম্বার হরিণ প্রকৃতিতে বাঁচিয়ে রাখতে শিকার বন্ধে স্থানীয়দের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা প্রয়োজন।

বন্যপ্রাণী গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ আজিজ আজাদীকে বলেন, বাংলাদেশে সাম্বার হরিণের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। রাঙামাটির কাচালং, পাবলাখালী ও শিজক এলাকায় এই হরিণের অস্তিত্ব রয়েছে। এছাড়া বান্দরবানের সাঙ্গু, মাতামুহুরি সংরক্ষিত বনে সাম্বার হরিণ দেখা যায়। বিরল প্রজাতির এই হরিণ গভীর বনে নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে। তবে কাপ্তাই এলাকায় এই প্রথম সাম্বার হরিণ পাওয়ার খবর দেখলাম। সাম্বার হরিণ আকারে বড় হওয়ার কারণে চিত্রা ও মায়া হরিণের চেয়ে এগুলো শিকারের ঝুঁকি বেশি। চোরা শিকার বন্ধে বন বিভাগকে আরও তৎপর হতে হবে। বিশেষত যারা বন নির্ভর জনগোষ্ঠী রয়েছেন; তাদেরকে নিয়ে কাজ করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের বর্ণাঢ্য কর্মসূচি
পরবর্তী নিবন্ধযুদ্ধে নিহত ইরানিদের গণজানাজা, তেহরানে মানুষের ঢল