ডিবির অনুরোধেই কলকাতার পুলিশ সঞ্জিভা গার্ডেনসে স্যুয়ারেজ লাইন ও সেপটিক ট্যাংকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের লাশের খোঁজ শুরু করে বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। তিনি বলেছেন, ঢাকায় গ্রেপ্তার এক আসামি জিজ্ঞাসাবাদে সেই রাতে অনেকবার বাথরুম থেকে পানির (ফ্ল্যাশ করার) শব্দ পাওয়ার কথা বলেছিলেন, যার সূত্র ধরেই সেপটিক ট্যাংকে তল্লাশি করার ধারণা মাথায় এসেছিল। এমপি আনার হত্যা মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে পাঁচ দিনের কলকাতা সফর শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকায় ফেরেন হারুনসহ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তিন কর্মকর্তা। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে হারুন দাবি করেন, তাদের এ সফর শতভাগ সফল হয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
গোয়েন্দাদের ভাষ্য– কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনস নামে অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের একটি ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে গত ১৩ মে ঝিনাইদহ–৪ আসনের সংসদ সদস্য আনারকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর তার লাশ টুকরো করে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন ডিবির হাতে গ্রেপ্তাররা। ডিবির প্রতিনিধি দল ভারতে যাওয়ার আগে থেকেই কলকাতার বিভিন্ন খালে, জঙ্গলে এমপি আনারের লাশের অংশ বা দেহাবশেষের খোঁজ করছিলেন সেখানকার তদন্তকারীরা। তারা কিছুই পাননি। হারুনের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল যাওয়ার পর ২৮ মে সঞ্জিভা গার্ডেনসের সেপটিক ট্যাংক থেকে টুকরো টুকরো করে কাটা কয়েক কেজি মাংস উদ্ধার করা হয়; যেগুলো এমপি আনারের দেহাবশেষ হতে পারে বলে ধারণা দুই দেশের গোয়েন্দাদের।
কেন মনে হল সেপটিক ট্যাংকে খোঁজা দরকার? এমন প্রশ্নে হারুন বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে আমরা যখন দেখি সব জায়গা ব্যর্থ হচ্ছে, তখন আমাদের মনে হল, আমাদের কাছে একটা ‘ওয়াটার থিওরি’ তো আছে। যে তিনজন আসামি আমাদের কাছে ছিল, তাদের একজন বলেছিল রাতের বেলায় সে পানির শব্দ পাচ্ছিল। তারা বাথরুমে ঘন ঘন ফ্লাশ করেছিল। সেই ফ্ল্যাশ করে তারা কী ফেলেছিল? সেই ধারণা থেকে আমরা তখন বললাম, স্যুয়ারেজ লাইন ও সেপটিক ট্যাংকটা চেক করলে আলামতের কিছু অংশ পাওয়া যেতে পারে। সে অনুযায়ী তারা করেছে এবং আলামতের অনেকখানি পাওয়া গেছে।
ফরেনসিকের কোনো আলামত দেশে আনা হয়নি জানিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, আলামতের ডিএনএ পরীক্ষা তারাই করবে। উনারা বলেছেন দ্রুতই করা হবে। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এখানে আমরা যে ‘ডিজিটাল এভিডেন্স’ পাচ্ছিলাম, আমরা সরাসরি গিয়ে সেগুলো দেখলাম। তারা কোন সময় কোন গাড়িটা ব্যবহার করেছে, সংসদ সদস্য কোন সময় ঢুকলেন– এসব। তাদের ওখানে গ্রেপ্তার আসামিকে ক্রস এঙামিন করেছি। আমাদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল দেহের অংশ উদ্ধার করা। আমরা সেটাতেও সফল হয়েছি।
ঘটনার মাস্টার মাইন্ড শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে ডিবির হারুন বলেন, শাহীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরাতে ভারতের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকায় ভারতের মাধ্যমে তাকে ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রানধির জেসওয়াল সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বলেন, এ তদন্তে বাংলাদেশকে পূর্ণ সহায়তা দেওয়া হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রানধির জেসওয়াল বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এক্ষেত্রে সমন্বয় করছে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য আদানপ্রদান করছে। চলমান তদন্তের অংশ হিসাবে আমাদের দিক থেকে সরকার বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে পূর্ণ সহায়তা দিচ্ছে।
ঢাকায় সাংবাদিকদের হারুন বলেন, ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগ) ধারার মামলায় যত সময় পর্যন্ত ভিকটিমের দেহ বা দেহের অংশ বিশেষ উদ্ধার করা না যায়, তত সময় পর্যন্ত মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট, মেডিকেল রিপোর্ট, ভিসেরা রিপোর্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র তৈরি করতে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে অনেক বেগ পেতে হয়। এগুলো না হলে আবার মামলাটা নিষ্পত্তি করাও অনেক কঠিন হয়ে যায়। এখন এসব এভিডেন্স নিয়ে আমাদের সমস্যা হবে না। সেখানে গিয়ে কলকাতার সিআইডি আইজির সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জিহাদ বলে একজনকে গ্রেপ্তার করে। আমরা তাকে ‘ক্রসএঙাজিম’ করেছি। ঝড়–বৃষ্টির মধ্যে পুলিশসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে আমরা নিজেদের চোখে সব দেখে মূল যে (সন্দেহভাজন) ঘাতক (শিমুল ভূঁইয়া) তার বর্ণনার সেখানকার বিষয়গুলো মিলিয়েছি। আমাদের মূল কাজ ছিল আলামত উদ্ধারে কলকাতা পুলিশকে সহায়তা করা। দ্বিতীয়ত ছিল, সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ ডিজিটাল এভিডেন্স সংগ্রহ করা এবং পারিপার্শ্বিক অন্যান্য সাক্ষ্য–প্রমাণ মিলিয়ে দেখা। ঘটনাস্থলে গিয়ে খতিয়ে দেখা। সব কিছুতে আমরা শতভাগ সফল হয়েছি।
উদ্ধার হওয়া মাংসের টুকরাগুলো এমপি আনারেরই হতে পারে– হারুনের এমন দৃঢ় ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চান, তাহলে এমপির লাশ এর বাকি অংশ উদ্ধারে কি কোনো আশা দেখছেন? তিনি বলেন, আমি এখনও আশাবাদী।
কলকাতায় এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, এর সঙ্গে ভারতের কারো কোনো যোগসূত্র পাওয়া গেল? হারুন বলেন, এখানে নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। প্রাথমিক তদন্তে মূল ঘাতক ও ভারতে গ্রেপ্তার ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে আমরা মোটাদাগে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ঘটনায় যুক্তরা বেশিরভাগই বাংলাদেশি। বাকি কেউ যদি থাকে, থাকতে পারে। ভারতের পুলিশ, সিআইডি তারা অত্যন্ত দক্ষ তারা কাজ করছে, আমরাও করছি। এখনই শেষ বলে কিছু নেই। এমপি আনারের বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গেও কাল দুই ঘণ্টা কথা হয়েছে। তিনি কী ব্যবসা করেন তাও আমরা জেনে এসেছি। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনি তা বলছি না।
ভারতের পুলিশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নকেও এই সফরের বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন হারুন অর রশীদ। তিনি বলছেন, যখন কোনো অপরাধী বাংলাদেশে অপরাধ করে ভারতে চলে যায় আমরা এত দিন ফোন যোগাযোগের মাধ্যমে ভারত থেকে অপরাধী ফিরিয়ে এনেছি। এবারের সফরে আরেকটা সাফল্য হল, সেখানে গিয়ে প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টের ছোট–বড় সব কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। আমি মনে করি বাংলাদেশের কোনো অপরাধী এখানে অপরাধ করে ভারতে ‘সেফ হেভেন’ বানাবে, কলকাতার সহায়তায় সেটি হতে দেব না আমরা। অনুরুপভাবে বাংলাদেশকেও ভারতের অপরাধীদের সেফ হেভেন হতে দেব না।