পানির জন্য ছটফট করেছিল ছেলে, আজও চোখে ভাসে সেই দৃশ্য

শহীদ ইশমামুল হকের মা শাহেদা

মোহাম্মদ মারুফ, লোহাগাড়া | শনিবার , ২৬ জুলাই, ২০২৫ at ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রজনতার আন্দোলনে শহীদ ইশমামুল হকের মা শাহেদা বেগম বলেন, অপারেশনের পর বারবার পানি পান করার জন্য ছটফট করেছিল ছেলে। বলেছিল আম্মু আমাকে একটু পানি দাও। কিন্তু চিকিৎসকের নিষেধ থাকায় দিতে পারি নাই। পানি পান না করেই পরপারে চলে গেল আমার ছেলে ইশমাম। ছেলেকে পানি দিতে না পারার সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। বারবার মনে পড়ে ইশমামের বলা শেষ কথাগুলো।

শহীদ ইশমামের বাড়ি লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের দর্জিপাড়ায়। তারা ছিলেন তিন ভাই। বড় মুহিবুল হক (১৯) আর ছোট ভাই আবু বক্কর সিদ্দিক তানভীর (১৩)। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতা যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে গুলিবিদ্ধ হন ইশমামুল। পুলিশের ছোড়া গুলি তার পেটের মাঝ বরাবর লাগে আর পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় এই তরুণের। ফলে ছাত্রজনতার চূড়ান্ত বিজয় রাজপথে থেকে দেখে যেতে পারেননি তিনি। এমনকি অংশ নিতে পারেননি বিজয় মিছিলেও।

শহীদ ইশমামুল হকের মায়ের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে বাবার কষ্ট ঘুচাবে। সুন্দর একটি বাড়ি হবে তাদের। দুঃখ দূর হবে। অভাব দূর হবে। হবে একটি সুখের সংসার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। ৮ বছর আগে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর মারা যান তার বাবা নূরুল হক। চিকিৎসায় ব্যয়ের টাকাও অনেকের কাছ থেকে ধার নিতে হয়েছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর ভেঙে যায় মা শাহেদা বেগমের স্বপ্ন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি না থাকায় শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই। বন্ধ হয়ে যায় ইশমাম ও তার ভাইয়ের পড়ালেখা।

২০১৯ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে লোহাগাড়া উপজেলা সদর বটতলী স্টেশনে একটি কাপড়ের দোকানে প্রথম চাকরি শুরু করে ইশমাম। ২০২৩ সালে সেখান থেকে আরো বাড়তি আয়ের আশায় রাজধানীর চকবাজারে একটি জুয়েলারি দোকানে চাকরি নেয়। ইশমাম ঢাকায় ও তার বড় ভাই মুহিবুল উপজেলা সদর বটতলী স্টেশনে একটি দোকানে চাকরি করত। সে টাকায় কোনো রকম চলছিল তাদের সংসার ও ছোট ভাই আবু বক্করের লেখাপড়া। মা শাহেদা বেগম আবারও স্বপ্ন দেখা শুরু করল ছেলেদের আয়ের কিছু অংশ জমা করে ইশমামকে বিদেশ পাঠাবে। ভালো আয়ের উৎস হবে। সুখের সংসার গড়বে। তা আর হয়ে উঠল না। অধরাই রয়ে গেল বিধবা মায়ের স্বপ্ন।

আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ইশমামের পরিবারের সব এলোমেলো করে দিয়েছে। নিঃস্ব পরিবারটি আজ মানবেতর জীবনযাপন করছে। দেড় শতকের মতো থাকার জায়গা ছাড়া কিছুই নেই তাদের। বর্তমানে ইশমামের বড় ভাই মুহিবুল উপজেলা সদর বটতলী স্টেশনে একটি গ্যাসের দোকানে ৫ হাজার টাকার বেতনে চাকরি করেন। এখন তার পরিবারের সংসার চালানো ও মাদ্রাসা পড়ুয়া ছোট ভাই আবু বক্করের পড়ালেখার খরচ চালানো খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনো পর্যন্ত সরকারি কোনো আর্থিক সহযোগিতা পায়নি তার পরিবার। সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র করে দেওয়া হয়েছে। যা ৫ বছর পূর্ণ হলে টাকা পাবে বলে জানান শাহেদা বেগম।

ইশমামুলের বড় ভাই মহিবুল হক বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচি ছিল। আমার ভাই ইশমামুল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এই কর্মসূচিতে যুক্ত হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে উপস্থিত ছাত্র জনতা সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শহীদ মিনার থেকে মিছিল নিয়ে চানখারপুলের দিকে রওনা হয়। মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় ইসমামুলের শরীরে এসে গুলি লাগে। পুলিশের একটা গুলি আমার ভাইয়ের পেটের মাঝ বরাবর লাগে এবং পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। তাকে মিছিল থেকে দ্রুত উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার অবস্থার অবনতি হলে আইসিউতে নেওয়া হয়। সেখানে ৭ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার ভাই মারা যায়।

ইশমামুলের মৃত্যুর ঘটনায় মহিবুল হক বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, সহকারী পুলিশ কমিশনার ইমরুল ইসলামের সরাসরি নির্দেশ ও অনুমোদনক্রমে অজ্ঞাতনামা পুলিশদের দ্বারা মিছিলে গুলি করা হয়। এছাড়া মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ, সহকারী পুলিশ কমিশনার শুভ্র দাসকেও নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিমান প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্নের কাছেই ছিলেন ওমর
পরবর্তী নিবন্ধসময় বাঁচল, সিস্টেম লসও হলো না