দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষায় পাঠদানরত শিক্ষকদের মানের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে অনেক বছর ধরেই। এনিয়ে অসন্তোষ রয়েছে খোদ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও, যার ব্যতিক্রম নয় কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকেরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এক সাম্প্রতিক গবেষণায়ও দেখা গিয়েছে এর প্রতিফলন। গবেষণায় উঠে আসে, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থীদের ৯২ শতাংশই তাদের শিক্ষকদের মান নিয়ে অসন্তুষ্ট। পত্রিকান্তরে সম্প্রতি এ খবর প্রকাশিত হয়।
সরকার দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবে পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। উপরে উল্লেখিত গবেষণার ফল অন্তত সে কথাই বলছে। শিক্ষকদের পাঠদানে ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী অসন্তুষ্ট থাকা যেমন তেমন কথা নয়। পাঠদানে অসন্তুষ্ট এ ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী আবার কারিগরি শিক্ষাবোর্ড থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স পাস করে বের হওয়া। তাই এদের মতকে খাটো করে দেখা যায় না। শিক্ষার গুণগত মান অনেকাংশে নির্ভর করে শিক্ষকের যোগ্যতার উপর। যদিও শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে নিয়োগে অনিয়ম ও নিয়মিত প্রশিক্ষণের অভাবে তাদের সে যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ খুবই কম। ১৯৬৬ সালে অল্প কয়েকটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত দেশের একমাত্র টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তির আসন সংখ্যা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৩০ জনই আছে। ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অস্তিত্ব এখন আর নেই বলে মনে হয়। অথচ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা নিয়ে জোরে শোরে মাঠে নামলেই বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলার জন্য শিক্ষকরাই তৈরি হতে না পারেন তাহলে তারা কিভাবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবেন? এশিয়ার প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অনেক উন্নত দেশ জায়ান্ট চীন ও সিঙ্গাপুর নিজেদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার চমৎকার অবকাঠামো গড়ে তুলেছে, পাশাপাশি এ ধরনের কাজের সামাজিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করতে পেরেছে। সেজন্য অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি সমাজে কারিগরি কাজের কর্মীদের মূল্যায়নের বিষয়টির ওপরও জোর দিতে হবে।
কারিগরি শিক্ষার জন্য পৃথক শিক্ষা বোর্ড গঠন হলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রের স্বল্পতা, শিক্ষকদের অদক্ষতাসহ নানা কারণে মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে তারা, প্রযুক্তিগত শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও অপ্রতুল। ফলে তরুণরা উচ্চ শিক্ষার সনদ অর্জনে সফল হলেও কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে! করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থান নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। জাতির কর্মদক্ষতা ও আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে হলে গুণগত মান সম্পন্ন কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। বৈশ্বিক ও স্থানীয় মানদন্ডে একটি ‘স্কিল ম্যাপ’ তৈরি করতে হবে এবং চাহিদা অনুসারে দক্ষতার ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করতে হবে। নতুন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বিদ্যমান মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন আনতে হবে এবং এর পরিবর্তে দক্ষতা নির্ভর ব্যবহারিক ও কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উচ্চ শিক্ষা স্তরে দক্ষতা নির্ভর কোর্স চালু করতে হবে। এবং শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষ জনবল তৈরি। এখন দেখা যাচ্ছে, সাধারণ কোর্স করা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কারিগরি কোর্স করা শিক্ষার্থীদের দক্ষতার মাত্রাই আলাদা করা যাচ্ছে না। মূলত মানসম্মত শিক্ষকের অনুপস্থিতি ও পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাবে কারিগরি শিক্ষার সুফল মিলছে না। শিক্ষকের জ্ঞানগত দুর্বলতার কারণে শিক্ষার্থীরাও দক্ষ হয়ে উঠতে পারছে না।
বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে খন্ডকালীনভাবে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। আমরা জনশক্তি রফতানিতে এখনো যেমন অদক্ষ ক্যাটাগরিতে রয়েছি, তেমনি দেশে দক্ষ জনবলের অভাবে বিদেশ থেকে লোক আনছি। এজন্য জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের করিগরি মডেল আমাদের অনুসরণ করতে হবে। জার্মানিতে কারিগরি শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ। আমাদের দেশে এ শিক্ষার হার অন্তত ৬০ শতাংশে উন্নীত করার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক। চীন মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর উন্নতির মূলে রয়েছে কারিগরি শিক্ষা। বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে এগিয়ে যেতে হলে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।