বলা হয়ে থাকে, ‘লেখক যেমন পাঠক তৈরি করেন, পাঠকও তৈরি করেন লেখককে। তারা একে অপরের পরিপূরক, সম্পূরকও বটে’। এটাও সত্য, লেখকের প্রতি পাঠকের সবসময় বাড়তি আকর্ষণ থাকে, থাকে শ্রদ্ধাবোধ। যার লেখা পড়ে মুগ্ধ হওয়া তার প্রতি পাঠকের কৌতুহল থাকাও স্বাভাবিক। একইভাবে লেখকের গুপ্ত সম্পদ হচ্ছে পাঠকের ভালোবাসা। নিজের সৃষ্টি পাঠকের কাছে সমাদৃত হলেই আনন্দ পান লেখক। অর্থাৎ লেখক তার রচনার মধ্য দিয়ে পাঠকের মধ্যে এক ধরনের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এ সম্পর্ক গাঢ় হয় বইমেলার কল্যাণে। নগরীর সিআরবি শিরীষ তলায় চলছে বইমেলা। এ মেলা পাঠককে সুযোগ করে দিয়েছে লেখকের কাছে যাওয়ার। পছন্দের লেখককে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন তারা। দিচ্ছেন আড্ডা। লেখক–পাঠকের অন্তরঙ্গ আলাপনে প্রাণসঞ্চার ঘটছে মেলায়। লেখকের সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পাঠক নতুন কেনা বইয়ে নিচ্ছেন অটোগ্রাফ। তুলছেন ছবি বা সেলফি। পাঠকের এমন উচ্ছ্বাসে বিরক্তি ও ক্লান্তি স্পর্শ করছে না লেখককে। বরং যেন উজ্জ্বীবিত হচ্ছেন। তাই হাসিমুখে পাঠকের চাওয়া মেনে পূরণ করছেন আবদার। দিচ্ছেন অট্রোগ্রাফ, তুলছেন ছবি।
গতকাল শনিবার ছিল বইমলার ১৬তম দিন। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে প্রথমা প্রকাশনা স্টলের সামনে দেখা যায় কিশোর–কিশোরী ও তরুণ–তরুণীদের ভিড়। ভিড় এড়িয়ে কাছে যেতেই দেখা গেল এ সময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হককে। অর্থাৎ তাকে ঘিরেই সৃষ্টি হয়েছে ভিড়। এবার বেরিয়েছে তার উপন্যাস ‘কখনো আমার মাকে’। উচ্ছ্বসিত পাঠকদের কেউ তার অটোগ্রাফ নিচ্ছিলেন। কেউ তুলছেন ছবি। প্রায় পৌনে ২ ঘণ্টা অবস্থান করেন তিনি। যার পুরোটা সময়ই পাঠকবেষ্টিত ছিলেন তিনি। এরপর বইমেলা মঞ্চে ‘লেখক সম্মিলনে’ প্রধান আলোচকের বক্তব্য রাখেন। লেখক সম্মিলনে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
পাঠককে অটোগ্রাফ দেয়ার এক ফাঁকে আজাদীকে আনিসুল হক বলেন, সবসময় দেখেছি চট্টগ্রামের লোক বেশি বই ও পত্রিকা পড়েন। চিন্তার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম আমাদের বহুবার দিশা দেখিয়েছে। চট্টগ্রামের মানুষ অগ্রসর চিন্তার মানুষ। এসময় এবারের বইমেলার আয়োজনটা ভালো হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। রাঙ্গুনিয়া থেকে মেলায় আসা নোহা আজাদীকে বলেন, আনিসুল হক আমার পছন্দের লেখক। তার আসার খবর পেয়ে মেলায় এসেছি। ‘কখনো আমার মাকে’ কিনেছি, এতে অটোগ্রাফও নিয়েছি।
শৈলী প্রকাশনার স্টলে দেখা যায় অটোগ্রাফ দিচ্ছেন কবি রাশেদ রউফ। এবার প্রকাশিত তার কাব্যগ্রন্থ ‘আমি সূর্য তমি সূর্যমুখী’ নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন পাঠকরা। এছাড়া ইউপিএল এর স্টলে ‘সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ দস্যুদের রূপান্তরের গল্প’র লেখক সাংবাদিক মোহসীন–উল হাকিম এবং অক্ষরবৃত্তের স্টলে ‘আত্মহত্যার আত্মকথা’র লেখক ও পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীনকে ঘিরে পাঠকের উচ্ছ্বাস দেখা গেছে।
এছাড়া গত কয়েকদিন ধরে মেলা ঘুরে দেখা গেছে, হরিশংকর জলদাস, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ওমর কায়সার, অভীক ওসমান, বাদল সৈয়দ, আজাদ বুলবুল, হাসান আকবর, মহীবুল আজিজ, অঞ্জন নন্দী, কামরুল হাসান বাদল, জয়নুল টিটো, হিমেল মাহমুদ, মাইনুল এইচ সিরাজী, আলমগীর মোহম্মদ, শহিদ হাসান, সৈয়দ করিমুননেসা, বিভা ইন্দু, শেখ বিবি কাউছার, সোহেল ইয়াছিন, ইউসুফ মুহাম্মদ ও শামসুদ্দিন শিশিরসহ মেলায় আগত লেখকদের ঘিরে পাঠকদের উচ্ছ্বাস।
‘আত্মহত্যার আত্মকথা’র লেখক মোহাম্মদ মহসীন আজাদীকে বলেন, ২০২১ সালে চুয়াডাঙ্গায় সদর থানার ওসি ছিলাম। তখন দেখেছি প্রায় প্রতিদিন ৮–১০ জন লোক আত্মহত্যা করে বা আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বিষয়টি আমাকে নাড়া দেয়। তখন থেকে এটা নিয়ে কাজ শুরু করি। স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বুঝাতে চেষ্টা করি, আত্মহত্যা বোকামি ছাড়া কিছু না। আত্মহত্যাকারী নিজের সাথে প্রতারণা করে এবং পরিবারকে ভিন্ন ধরনের যন্ত্রণায় ফেলে দেয়। আত্মহত্যার বা চেষ্টা করেছেন এমন ২৯টি ঘটনা বইটিতে উল্লেখ আছে।
এদিকে নতুন প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর পাঠকপ্রিয় হওয়া গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– মুহাম্মদ শামসুল হকের ‘রক্ত অনল অশ্রুসজল একাত্তর’, আলমগীর মোহাম্মদ এর ‘বাঙালি মুসলমানের অতীত’, আখতারুল ইসলামের ‘মহাবিশ্ব ও মহাকাশ পরিচিতি’ ও নিলুফা ইয়াসমিন জয়িতার ‘ভালোবাসার অজুহাত’।
লেখক সম্মিলন : গতকাল বইমেলা মঞ্চের আয়োজন ছিল ‘লেখক সম্মিলন’। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। প্রধান বক্তা ছিলেন লেখক আনিসুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন লেখক জয়নুল টিটো। কবি ও প্রাবন্ধিক অভিক ওসমানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বই মেলা কমিটির আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু।
আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, বই মানুষকে সামাজিক অবক্ষয় থেকে দূরে রাখে। জ্ঞানের দুয়ার খুলে গেলে অপশক্তির কপাট বন্ধ হয়ে যায়। নতুন পাঠক সৃষ্টি করতে নতুন বইয়ের বিকল্প নেই। বই কেনা ও পাঠের অভ্যাস গঠনে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের সুযোগ করে দেয় বই মেলা। একুশের বই মেলা নবীন–প্রবীণদের সংযোগ রচনায় প্রকৃতই এক মিলন তীর্থ।
আনিসুল হক বলেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে চট্টগ্রাম। এমনকি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলন করছিলাম তখনো চট্টগ্রামের ভূমিকা অনেক ব্যাপক ছিল। বিজয়ের মেলা কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে শুরু হয়। চট্টগ্রাম থেকে বহু কিছু হয়েছে। পৃথিবী ব্যাপী বাংলাদেশের যেসব গায়েকরা সুনাম অর্জন করেছেন তাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রামের। চট্টগ্রাম আমাদের আলো দেবে, নিঃশ্বাস দেবে খুবই স্বাভাবিক।
বিয়ের আগে হবু বউয়ের মন পেতে বিসিএস ক্যাডার হয়ে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়েওতে। প্রথম বেতন নিতে এসেছিলেন সিআরবি। সেই স্মৃতিও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।