বলেই হিহি করে হাসল আর হাততালি দিল শালিক।
(ভুল হয়ে গেল। পাখির তো হাত নেই। আছে ডানা বা পাখা। কাজেই ওদের ক্ষেত্রে বলতে হবে ডানাতালি বা পাখতালি। মনে হয় পাখতালিটাই ভালো শোনাবে।)
পাখতালি দিতে দিতে শালিক বলল, কী দারুণ না?
চড়ুই হাসল না। মুখ গোমড়া করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
কী ব্যাপার, কী হলো তোমার? ভালো লাগেনি?
কিছু শোনেনি এমন ভান করে চড়ুই বলল, আমারটা শুনবে?
শোনাও, শোনাও। অনেক উৎসাহ নিয়ে শালিক বলল।
শালিক আর চড়ুইয়ের বন্ধুত্বটা অনেক দিনের। একই এলাকায় থাকে ওরা। শহরের এদিকটায় এখনও বেশকিছু গাছপালা আছে। ছোট ছোট টিলার আশেপাশে প্রচুর গাছপালা। বর্ষা এলে নিচু জায়গাগুলোতে পানি জমে থাকে। দেখতে অপূর্ব লাগে। সে পানিতে হয়ত মাছও জন্মে। কারণ তখন বক, মাছরাঙার মতো পাখিরা এসে ভিড় করে এখানে।
এসব ঘিরে এখানে অনেক ধরনের পাখি বাস করে। পাশাপাশি থাকতে থাকতে একসময় ওদের দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দিনে কয়েকবার ওরা একটা জামগাছে বসে নানা বিষয়ে আলাপ করে।
তাহলে শোনো। বলল চড়ুই।
গাছের ডালে শুলুক
বলল জোরে কুলুক।
বলেই চড়ুই হিহি করে হাসল আর পাখতালি দিল।
শালিক হাসল না। অবাক হয়ে বলল, এটা কী হলো?
কেন? ছড়া হলো। বলল চড়ুই
শুলুক মানে কী? শালিক বলল।
শুলুক মানে শালিক। এটা বলার জন্য যেন তৈরি ছিল চড়ুই।
তুমি চড়ুইকে চড়াই বানাতে পারলে আমি কেন শালিককে শুলুক বানাতে পারব না।
তার কথায় চড়ুই কেন আগে খুশি হয়নি তা বুঝতে পারল শালিক।
বলল, বন্ধু তুমি খামোখা আমার সঙ্গে রাগ করছো। এই ছড়া তো আমি বানাইনি। একদিন একটি বাসার বারান্দায় বসেছিলাম তখন শুনেছিলাম একটি শিশু এই ছড়াটা পড়ছে। আমি ভাবলাম তুমি খুব খুশি হবে এখানে আমাদের দুজনের নাম বলা আছে। অসহায়ের মতো বলল শালিক।
মানুষের কথা বলো না ভাই। ওরা না সবকিছু করতে পারে। ওরা কত পাখিভাইকে মেরেছে জানো? আর নাম নিয়ে ব্যঙ্গ করা তো ওদের স্বভাব। একবার ভুল করে মানুষের ঘরে ঢুকে গিয়েছিলাম। ওরে বাপ রে সে কী কাণ্ড! আমাকে কেউ ধরতে চায়, কেউ মারতে চায়। অনেক কষ্ট করে রক্ষা পেয়েছিলাম সেদিন।
এখনো রাগ কমেনি চড়ুইয়ের।
চল আমরা একটা চক্কর দিয়ে দেখে আসি কে কেমন আছে। বন্ধুর রাগ কমাতে প্রস্তাব দিল শালিক। চড়ুই বলল, চলো।
এভাবে একদিন ঘুরতে বেরিয়েছিল ওরা। ফিরে এসে দেখে প্রচুর লোকজন জড়ো হয়েছে ওদের এলাকায়। কয়েকটি গাড়িও দেখা গেল ভিড়ের মধ্যে। ওরা খুব ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত সরে গিয়ে আরও ভিতরে ঢুকে মায়েদের খুঁজতে লাগল তারা।
এখানে অনেক গাছ ঘন হয়ে আছে। এখানে লুকিয়ে থাকতে সুবিধা। মানুষের আনাগোনা কম। খুঁজতে খুঁজতে একসময় দুজনেই পেয়ে গেল তাদের মায়েদের। সেখানে নানা জাতের নানা রঙের আরও পাখি এসেছে। সবার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা ও ভীতির ছাপ স্পষ্ট। তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ এক পাখি বলছে, তোমরা সবাই মন দিয়ে আমার কথা শোনো। আমাদের সবাইকে খুব তাড়াতাড়ি এই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমি মানুষজনের কথাবার্তা শুনেছি। ওরা কালকে থেকে এখানকার গাছগুলো কাটা শুরু করবে। এখানে বাড়ি হবে, মানুষের বসবাস হবে, মার্কেট হবে। কাজেই আমাদের থাকার আর জায়গা থাকবে না। গাছপালা আছে এমন কোনো জায়গায় আমাদের চলে যেতে হবে। পারলে আজকে থেকে খোঁজাখুঁজি শুরু করো।
একটি পাখি বলল, কাছাকাছি তো আর গাছপালা নেই। মানুষ তো সব কেটে ফেলেছে। ওদের জ্বালায় আমরা পশু–পাখিরা বাঁচব না বোধহয়।
মুরুব্বি পাখিটি বলল, এখন এসব বলে সময় নষ্ট না করে মানুষের হাত থেকে কীভাবে বাঁচবে সে চিন্তা করো।
পরদিন সকালে শালিক ও চড়ুই দু বন্ধু উড়ে এসে দেখল, যে জামগাছটিতে বসে ওরা আড্ডা দিত সে গাছটি কাটা হয়ে গেছে। ওদের মনে পড়ল জাম পাকার দিনগুলোর কথা। জাম পাকলে এ গাছে অনেক ধরনের পাখি আসতো। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মনে হতো এখানে পাখিউৎসব হচ্ছে। যেসময় জাম পাকতো সেসময় অনেক শিশুরাও আসতো দল বেঁধে জাম কুড়াতে। সে স্মৃতি মনে করে দু বন্ধুর মন খারাপ হয়ে গেল।
একসময় নীরবতা ভেঙে শালিক বলল, বন্ধু চড়ুই চলো এখান থেকে চলে যাই। এত লোকজনের কাছাকাছি থাকা নিরাপদ নয়। ওরা যেকোনো সময় পাথর ছুঁড়ে মারতে পারে। ওদিকে সবাই মনে হয় আমাদের খুঁজছে। এখন থেকে নতুন ঠিকানা খুঁজতে হবে। কে কোথায় যাব জানি না।
আচ্ছা মানুষগুলো এমন কেন বলতে পারো? ওরা যদি এমন করে গাছপালা কেটে কেটে সবকিছু উজাড় করে দেয় তাহলে আমরা পশু–পাখিরা বাঁচব কেমন করে? বলতে বলতে কেঁদেই দিল চড়ুই।
একটি ডানা চড়ুইয়ের মাথায় রেখে শালিক বলল, কেঁদো না ভাই। সব মানুষ কিন্তু খারাপ না। ওদের মধ্যে অনেকে আছে ভালো যারা পশুপাখির কথাও ভাবে। মা বলেছে, অনেক দূরে নাকি একটা অভয়ারণ্য আছে। সেখানে পশু–পাখিরা নিরাপদে থাকতে পারে।
চড়ুই হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল,
শালিক, শালিক, শালিক
মানুষ তোমার মালিক
শুনে শালিকের খুব মন খারাপ হলো।
তুমি এভাবে বললে কেন? মানুষ কেন আমার মালিক হবে, আমি মানুষের খাই না পরি?
না, তুমি কেবল মানুষের পক্ষে বলতো সেজন্য বললাম। শোনো, সারাদেশের গাছ কেটে সাফ করে একটা–দুটা অভয়ারণ্য বানালে চলবে? সেখানে আমাদের সবার জায়গা হবে? সেটাও তো দখল করে নিচ্ছে অনেকে।
শালিক বলল, এসব কথা থাক। আজকের পরে কে কোথায় যাব জানি না। তুমি ভালো থেকো বন্ধু।
চড়ুই বলল, তা বটে। যাক, কোনো ভুল করে থাকলে ক্ষমা করে দিও বন্ধু। তোমার কথা কোনোদিন ভুলব না।
শালিক আর চড়ুই উড়ে গেল আরও ভিতরে যেখানে অনেক পাখি অপেক্ষা করছে একটি নতুন আবাসের সন্ধানে বের হবে বলে।