২০২৫ সালের মে মাসের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহটা কেটেছে নানা উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায়। সপ্তাহের শুরুতে পাকিস্তানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আরেকটা দুশ্চিন্তা ভর করেছিল। শেষ পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় চারদিনের মধ্যেই দুই দেশ যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয়ে তা দ্রুত কার্যকর করে। সারাবিশ্ব এতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ভারত ও পাকিস্তান দুটিই পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। দু‘দেশের হাতেই রয়েছে পারমানবিক অস্ত্র। ভয়ের কারণটা এ জন্যেই ছিল বেশি। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর দু‘দেশই তাদের সাফল্য দাবি করছে। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরাদি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যুদ্ধে দুই দেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক হলেও এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে চীন। যুদ্ধের শুরুতেই চীন পাকিস্তানের পক্ষে নিশর্ত সমর্থন দেয়। (১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল।) গত ৪০ বছর ধরে চীন সামরিক প্রযুক্তি উন্নয়নে বিলিয়ন বিলয়ন ডলার ব্যয় করেছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর অনেক নতুন মারণাস্ত্র তৈরি করেছে। কিন্তু কখনোই সরাসরি যুদ্ধে তার কার্যকারিতা যাচাইয়ের সুযোগ পায়নি। সাম্প্রতিক ভারত–পাকিস্তান সংঘাত তাদের সামনে সেই সুযোগ এনে দেয় এবং চীন তার সফল সদ্ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। যখনই ভারতের কেনা পশ্চিমা কোনো ড্রোন বা ফ্রান্সের রাফাল যুদ্ধ বিমান ভূপাতিত করার খবর এসেছে নেপথ্যে উঠে এসেছে চীনের জে–১০ সি যুদ্ধবিমানের কথা।
আমেরিকার সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো বনি গ্লাসার বলেছেন, ‘চীনের জন্য এটি কেবল অস্ত্রের পরীক্ষা নয়, বরং গোয়েন্দা, স্যাটেলাইট ও সাইবার সক্ষমতারও চূড়ান্ত বিশ্লেষণ।’
এই যুদ্ধে চীন বুঝে গেছে, বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে কোন প্রযুক্তি কতটা কার্যকর। পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় চীনের অস্ত্র কতটা শক্তিশালী। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ ছিল চীনের সমরাস্ত্র পরীক্ষার টেস্টিং গ্রাউন্ড। এই যুদ্ধ চীনের জন্য হয়েছে পোয়াবারো।
পাক–ভারত যুদ্ধের মধ্যে আরও একটি বিষয় তুমুলভাবে আলোচনায় চলে আসে। সেটি হচ্ছে মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশের ভূমি ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার প্রসঙ্গটি। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রথম এটি সামনে নিয়ে আসেন মানবিক করিডোর দিতে বাংলাদেশ শর্তসাপেক্ষে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে মর্মে বক্তব্যের মাধ্যমে। যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, সরকার করিডোর দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
বিএনপিসহ দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল ‘করিডোর’ দেওয়ার বিরোধিতা করছে। করিডোর দেওয়া হলে তা আমাদের জন্য কতটা আত্মঘাতী হবে সেটিও বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। এমনিতেই রোহিঙ্গারা আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন মানবিক করিডোরের নামে বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিদেশীদের ব্যবহার করতে দিলে তা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এই কথাটি প্রায় সব রাজনৈতিক দল বলছে। অন্তর্র্বর্তী সরকারকে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্ত না নিয়ে তা নির্বাচিত সরকার এবং আগামীর জাতীয় সংসদের উপর ছেড়ে দেওয়ার দাবিতেও ঐকমত্য দেখা গেছে।
আলোচনা–সমালোচনা ও বিতর্কে তুঙ্গে ছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতীয় সংগীত প্রসঙ্গ। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সফল গণঅভ্যুত্থান এবং শেখ হাসিনার পলায়ন পরবর্তী সময়েও যখন এই বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল তখন থেকেই বিএনপি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে। এখন আবার নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই বিতর্ক এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামীর বাগযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। গত ৮ মে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে শাহবাগ অবরোধকালে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনে বাধা দেওয়ার পর থেকে বিষয়টি নিয়ে দু‘দলের মধ্যে বিবৃতি–পাল্টাবিবৃতির লড়াই চলছে।
হাসনাত আবদুল্লাহ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারির একজন নেতা ও অন্যতম মুখ্য সমন্বয়ক। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠিত হওয়ার পর দলটিতে তার পদ মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল)। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে তিনি হঠাৎ কিছু অনুসারী ও সমর্থক নিয়ে রাতে দাঁড়িয়ে গেলেন রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে। পরে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন এবং সারজিস আলমসহ অন্য নেতারা এসে সেখানে যোগ দেন। যদিও এনসিপির দলীয় সিদ্ধান্তে সমাবেশটি হয়নি। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীরা এসে সেই সমাবেশকে চাঙ্গা করে তোলে। হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কিছু দলের নেতাকর্মীরা এতে যোগ দেন। অন্তর্র্বর্তী সরকার উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভা করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলে হাসনাত বাহিনী রাজপথ ছেড়ে যায়। এই সমাবেশ চলাকালে ছাত্র তরুণরা সেখানে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের উদ্যোগ নিলে জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দলের নেতাকর্মীরা বাধা দেয়। সমাবেশে ‘গোলাম আযমের বাংলায়’, ‘সাঈদীর বাংলায়’এভাবে স্লোগান দেওয়া হয়। সেই কর্মসূচিতে পরদিন রাতে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনে বাধা দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত জানার পর শাহবাগ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় মিছিলে বিএনপির বিরুদ্ধে ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে শ্লোগান দেওয়া হয়। সমাবেশটিতে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। বিএনপি শুরু থেকেই ‘৭১ প্রশ্নে তাদের জোরালো অবস্থান পরিষ্কার করে। বিভিন্ন মহল থেকে সমাবেশটি অন্তর্র্বর্তী সরকারের কারো ইশারা–ঈঙ্গিতে হয়েছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে স্লোগান উঠেছে, ‘কারো জন্য শীতল পানির ধারা, কারো জন্য লাঠিপেটা’ বলে। শাহবাগের সমাবেশে ৯ মে শুক্রবার রাতে দেয়া এসব স্লোগান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্র নেতাদের উদ্যোগে নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি‘র ভাবমূর্তি এতে মারাত্মক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। দু‘টি ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। শুরু থেকেই গুঞ্জন ছিল এনসিপি‘র সাথে জামায়াতের সখ্যতা নিয়ে। এ ঘটনা এনসিপির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। যার প্রেক্ষিতে এনসিপি ‘৭১ প্রশ্নে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে। দু‘দিন পর এনসিপি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ৭১‘এর প্রশ্নে তাদের জোরালো অবস্থান ঘোষণা করে বলেছে, তাদের কোনো সদস্য এই জনপদের মানুষের সংগ্রাম ও ইতিহাসবিরোধী কোনো শ্লোগান দেয়নি। যারা একাত্তরে এই জনপদের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, তারা জাতির সামনে তাদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়।
এনসিপি‘র মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী বলেছেন, ‘একাত্তরকে অস্বীকার করে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ নেই। যদি কোনো গোষ্ঠী বা পক্ষ ৭১‘কে বাইপাস করে রাজনীতি করতে চায়, তাদের রাজনীতিটা বুমেরাং হবে। একাত্তর আমাদের ভিত্তিমূল। আমরা চব্বিশে সেটা রিক্লেইম করেছি। এই ভিত্তিমূল আমাদের থাকতে হবে।’ তবে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এ ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিলে তা জামায়াত–শিবির মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মাহফুজ আলম তাঁর পোস্টে বলেন, ’৭১ এর প্রশ্ন মীমাংসা করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে।…( পাকিস্তান অফিসিয়ালি ক্ষমা চাইলেও, তদুপরি আবারও ক্ষমা চাইতে রাজি হলেও যুদ্ধাপরাধের সহযোগীরা এখনো ক্ষমা চায়নি)। ইনিয়ে– বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে বয়ান বন্ধ করতে হবে। জুলাইয়ের পক্ষের শক্তির মধ্যে ঢুকে সাবোটাজ বন্ধ করতে হবে।’
শাহবাগে জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহবায়ক আবু বাকের মজুমদারের উদ্যোগে এই কর্মসূচিতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীসহ আরো সংগঠন অংশ নেয়। এ সমাবেশে ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘একাত্তরের বাংলায়, রাজাকারের ঠাঁই নাই’, ‘চব্বিশের বাংলায়, রাজাকারের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেওয়া হয়।
এবি পার্টির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ৫৪ বছরের সবচেয়ে বড় দুটি অর্জন ৭১ আর ২৪। হাজার বছরের সংগ্রামমুখর এ জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।’
এ নিয়ে জামায়াত নেতারাও বিভিন্নভাবে তাদের বক্তব্য, পাল্টা–বক্তব্য তুলে ধরতে থাকেন। তথ্য উপদেষ্টার ফেসবুক পোস্ট নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলেন। গোলাম আযমের পুত্র আমান আযমীসহ জামায়াত সমর্থিতরা ফেসবুকে বা ইউটিউবে বলতে থাকেন, ‘বাংলাদেশের যে জাতীয় সঙ্গীত তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনেক আগের লেখা এবং এতে কোথাও বাংলাদেশের নাম উল্লেখ নেই’। আবার এর রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন বলে উল্লেখ করে জাতীয় সঙ্গীত পাল্টানোর পক্ষে যুক্তি দেখাতে থাকেন।
বিএনপি মহাসচিবসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ৭১, জাতীয় সংগীত এবং সংবিধান বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। এ নিয়ে জামায়াতের সাথে বিএনপির দূরত্ব বেড়েছে। এমনকি মাঝেমধ্যে বাগযুদ্ধও হচ্ছে। এই সময়ে ৭১ এবং জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক জামায়াতকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে। তাই দলটির আমির সম্প্রতি নেতাকর্মীদের প্রতি বক্তৃতা –বিবৃতি প্রদানে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়েছেন।
জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলসমূহের মধ্যে সাম্প্রতিককালে বিভাজন যেমন স্পষ্ট হয়েছে তেমনি অন্তর্র্বর্তী সরকারের সমালোচনায়ও মুখর হয়েছে বিএনপিসহ একাধিক দল। সরকারও সবকিছু সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার কারণে। এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরই সকল বিতর্ক ও অনিশ্চয়তার অবসান ঘটাতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।