পরিবেশ : স্বস্তি নেই কোথাও

মাত্রাতিরিক্ত শব্দ ও বায়ুদূষণ, পাহাড়ও কমছে

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৫ জুন, ২০২২ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বাসা থেকে বের হয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন। অজান্তেই ঝুঁকিতে পড়েছে আপনার স্বাস্থ্য। ভাবছেন, কীভাবে সম্ভব? এ ঝুঁকি দুইভাবে হচ্ছে। প্রথমত রাস্তায় চলা অসংখ্য গাড়ির মাত্রাতিরিক্ত হর্ন সৃষ্টি করছে শব্দ দূষণ, যার প্রভাব পড়ছে শরীরে। এ দূষণের কারণে হৃদরোগের ঝুঁকির পাশাপাশি স্থায়ীভাবে শ্রবণ শক্তি হারানোরও আশঙ্কা আছে। দ্বিতীয়ত গাড়ির কালো ধোঁয়া ও কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং ধুলোবালিসহ অন্যান্য কারণে সৃষ্ট বায়ু দূষণ। এটাও শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
তবে কী শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে কোনো সবুজ উদ্যান বা পাহাড়ে ছুটে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন? যেখানে গাড়ির হর্নের বদলে আছে পাখির কিচিরমিচির! কিংবা আছে সবুজ গাছপালায় মন ভরে শ্বাস নেয়ার আয়োজন। সে আশাও পূরণ হবে না। কারণ শহরে পাহাড়ের সংখ্যা দিন দিন কমছে। যে কয়টি অক্ষত আছে সেখানেও বনায়ন নেই। আছে অবৈধ বসতি। গত ২৯ মে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্য অনুযায়ী, ৪০ বছর আগেও নগরে ২০০ পাহাড় ছিল, যার ৬০ শতাংশ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল আলম আজাদীকে বলেন, প্রতি মাসেই শব্দের মানমাত্রা পরীক্ষা করি। ৩০ পয়েন্টের পরীক্ষা করা হয়। তার একটিও সন্তোষজনক না। একইভাবে চারটি স্টেশন থেকে বায়ুর মানমাত্রা পরীক্ষা করা হয়। সেটাও ভালো না। এককথায় শব্দ ও বায়ুর মানমাত্রা খুব একটা ভালো না।

কলকারখানা, গাড়ি এবং ইটভাটার জন্য বায়ুদূষণ হয় জানিয়ে তিনি বলেন, কলকারখানা থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হয় সেটা নিয়ন্ত্রণে এটিপি (এয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) স্থাপন করতে বলি আমরা। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। কিন্তু চালায় না। এমনও হয়, আমরা অভিযানে গেলে চালায়। এজন্য আমরা অনেককে জরিমানাও করেছি। গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়ার জন্য বিআরটিএ এবং জেলা প্রশাসনের ভূমিকা একটু বেশি। এছাড়া পুরো চট্টগ্রামে ৩০০ থেকে ৩৫০টি ইটভাটা আছে, যার অনেকগুলোই অবৈধ। যারা উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে। পাহাড় কাটার বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিং করছেন বলে জানান তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহনগরের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক আজাদীকে বলেন, বায়ুদূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা শহরে কম। বেশিরভাগ এটিপি লাগিয়েছে। এটা আমরা মনিটরিং করি। আশা করছি স্বাভাবিক পর্যায়ে আসবে। শব্দ দূষণের ক্ষেত্রে শিল্পকারখানায় জেনারেটর থেকে হয়। সেটাও মোটামুটি পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারব। তবে যানবাহন-সৃষ্ট যে দূষণ সেটার জন্য সচেতনতা দরকার। কারণ চালকরা যেখানে দরকার নেই সেখানেও হর্ন বাজায়। শিল্পকারখানার পয়োঃবর্জ্য দূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সব প্রতিষ্ঠানের ইটিপির দরকার নেই। ২৭১টি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আছে। এর মধ্যে প্রায় ৯২ শতাংশ শিল্পকারখানার আছে। যেগুলোতে নেই তাদের নোটিশ করা হয়েছে।

বায়ু ও শব্দদূষণ : পরিবেশ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক পরীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ‘নীরব এলাকা’ শ্রেণিভুক্ত ১৫টি স্থানে শব্দের ৬৭ দশমিক ৬ থেকে ৮১ দশমিক ৫ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দের মানমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এছাড়া সাতটি আবাসিক এলাকায় ৬৭ দশমিক ৫ থেকে ৭৩ দশমিক ৫ ডেসিবেল এবং ৫টি বাণিজ্যিক এলাকায় ৭৯ দশমিক ৫ থেকে ৯৪ দশমিক ৫ ডেসিবেল পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়। অথচ আইন অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শব্দের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতের অন্য সময়ে এই মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় শব্দের এই মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ ও ৬০ ডেসিবেল।

এছাড়া শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬-এর বিধি ২ (ঞ) অনুযায়ী, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত বা একই জাতীয় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এবং তার চতুর্দিকে ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা হচ্ছে নীরব এলাকা। যেখানে গাড়ির হর্ন বাজানো যাবে না। অথচ গত বছরের আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ গেট এবং এ কে খান রোডের আল-আমিন হাসপাতালের সামনে শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৯ দশমিক ৫ ডেসিবল।

এদিকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাতাসের একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেঙ) শূন্য থেকে ৫০ হলে বাতাসের মান ভালো এবং ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত হলে অস্বাস্থ্যকর ধরা হয়। অথচ গত মার্চ মাসে সূচক ছিল ১৬৫, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত। এছাড়া গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র ক্যাপস-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশব্যাপী বায়ুমান পরীক্ষায় বায়ুদূষণের দিক দিয়ে নবম অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম।
পাহাড় কাটা : বেলার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নগরে গত ৪০ বছরে বিদ্যমান পাহাড়ের ৬০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়েছে। এর আগে ২০১২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, সর্বশেষ ৩০ বছরে প্রায় শতাধিক পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়েছে। বর্তমানে ৮৬টি পাহাড়ের মধ্যে মাত্র ১৩টি অক্ষত রয়েছে। এছাড়া মূল আয়তন থেকে ২২টি পাহাড়ের এক তৃতীয়াংশ ও ২৪টি পাহাড়ের দুই তৃতীয়াংশ নিশ্চিহ্ন হয়েছে। অর্থাৎ দুটো তথ্যই বলছে, দিন দিন পাহাড়ের সংখ্যা কমছে নগরে।

অথচ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ
পরবর্তী নিবন্ধতিন গৃহবধূকে অমানুষিক নির্যাতনের অভিযোগ