দৈনিক আজাদীর ১১ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রতি অনেকের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে। সংবাদটি হলো : গাছের জন্য শোকসভা। একটি ব্যতিক্রমী সংবাদ। এতে বলা হয়েছে, ‘শ্বাস নিতে পারছে না গাছ/ তার কই নার্সিংহোম/ গাছেরাও তুলছে আওয়াজ/ শুনি তার মৌন মাতম।’ ‘গাছ কাটার অধিকার কে দিল?’ গতকাল রোববার নগরীর শিশুপার্ক এলাকায় কাটা গাছের সামনে ‘হত্যা করা গাছেদের জন্য শোকসভা’য় গাছ নিয়ে ছিল এমন অনুভব আর প্রশ্ন। সাধারণ জনগণের ব্যানারে আয়োজিত হয় এই প্রতিবাদ সভা। এতে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরকে বৃক্ষশূন্য করা চলবে না। শিশুপার্ক এবং গরিবুল্লাহ শাহ কবরস্থানে গাছ কাটা বন্ধ হোক। আয়োজকরা জানান, সবুজে ঘেরা চট্টগ্রাম নগরীর সবুজ কমতে কমতে ক্রমশ শ্রীহীন ধূসর নগরীতে পরিণত হয়েছে। মানুষের অসীম চাহিদার কাছে নিরুপায় প্রাণ–প্রকৃতি। এক চিলতে সবুজও রাখা হবে না কোথাও– এমন মরণপণ করেছে যেন সব প্রতিষ্ঠান। যেখানে গাছ সেখানেই উন্নয়ন পরিকল্পনা। সবকিছু যেন মানুষের করায়ত্ত হওয়া জরুরি।
তারা বলেন, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সামনের জায়গাটুকু ছিল উন্মুক্ত, জনসাধারণের হাঁটা–চলা, বিশ্রাম কিংবা অলস সময় কাটানোর সবুজ এক চত্বর। সেটা লিজ দেওয়া হয় সিটি কর্পোরেশনের কাছে। সেখানে হয় শিশুপার্ক। অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার জন্য দীর্ঘ পঁচিশ বছর শেষে লিজ বাতিল করা হয়। ভেঙে ফেলা হয় শিশুপার্ক। কথা ছিল জায়গাটা আবার আগের মতো উন্মুক্ত থাকবে। কিন্তু সমপ্রতি সেখানকার গাছগুলো কাটা শুরু হয়। ইতোমধ্যে অনেকগুলো গাছ কাটা পড়েছে এবং বাকিগুলোও কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়েছে। ১২১টার বেশি গাছ এখনও ওই এলাকায় আছে। প্রতিবাদ সভায় বক্তারা বলেন, গরিবুল্লাহ শাহ মাজার কবরস্থানে চলছে ‘গাছ হত্যার’ মহোৎসব। বিপ্লব উদ্যানেও গাছ কেটে ইমারত বানানোর কাজ চলছে। এমইএস কলেজের পাশের কবরস্থানের সব গাছ কেটে মরুভূমি বানিয়ে ফেলেছে। বক্তারা পরিবেশ রক্ষায় গাছের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং আর একটা গাছও কাটা হলে কঠোর আন্দোলনের কথা বলেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঠিক সিদ্ধান্ত এই গাছগুলোকে রক্ষা করতে পারে বলে জানান তারা।
মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক অতি নিবিড়। কারণ প্রকৃতির কোলেই মানুষের বসবাস। তাই প্রকৃতির ক্ষতি হলে মানুষেরও ক্ষতি হয়। আমরা আজ নানাভাবেই প্রকৃতির ক্ষতি করে চলেছি। আজ প্রাকৃতিক পরিবেশ ভয়াবহ দূষণের শিকার। এতে চরম বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। পরিণামে বাড়ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। উষ্ণতার কারণে বরফ গলে যাচ্ছে হিমালয় এবং মেরু অঞ্চলের। এতে বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। পরিণামে তলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বিশাল নিন্মাঞ্চল। চট্টগ্রামের একটি বড় অংশও এর আওতাভুক্ত। পানি, বায়ু, শব্দদূষণ দিন দিন মাত্রা ছেড়ে যাচ্ছে। এতে হানা দিচ্ছে নানা রোগব্যাধি, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। নষ্ট হচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল। বিনাশ হচ্ছে সভ্যতা। এ অবস্থা চলতে থাকলে মানব–অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবেশ আজ বড়ই বিপন্ন। পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার ফলে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। মানবজীবনও হুমকিতে পড়েছে। পরিণামে জ্যামিতিক হারেই বাড়ছে পরিবেশ শরণার্থীর সংখ্যা।
পরিবেশ বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ এবং পরিবেশ দূষণের শিকার সচেতন জনগণের মতে, বৃক্ষ নিধন ছাড়াও প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষা না করা, রাসায়নিক সার ব্যবহার করা, কল–কারখানার বর্জ্য, পলিথিন ও পোড়া জ্বালানি, কালো ধোঁয়া, কীটপতঙ্গ ধ্বংস করা, বস্তির উদ্ভব, ঘনবসতি, ধূমপান, পানিতে মলমূত্র ও মৃত প্রাণীদেহ ফেলা, আর্সেনিক ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, গাড়ির হর্ণ ও মিলকারখানার শব্দ এবং অসচেতনতা ও শিক্ষার অভাব সর্বোপরি আইন অমান্য করা ও দেশপ্রেমের অভাবই পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করছে।
তাই সময় থাকতেই পরিবেশ সুরক্ষায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষতিকারক উপাদানগুলোকে পরিহার করতে হবে এবং পরিবেশ রক্ষায় জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো গেলে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে এবং সকলেই যার যার অবস্থান থেকে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে কাজ করলে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়া সম্ভব।