অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিবেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিক্ষার পাশাপাশি পরিবেশও অসামান্য ভূমিকা রাখে। পরিবেশের অনিবার্য অনুষঙ্গ ‘বন’ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও সমস্যা আছে। তবে এ দেশের মানুষ সমস্যা সমাধানের পথও খুঁজে পেয়ে থাকেন।
পরিবেশবিদদের মতে, একটি দেশের মোট এলাকার ২৫ শতাংশ এলাকায় বনভূমি থাকা দরকার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় কী পরিমাণ বনভূমি আছে সে বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১১ শতাংশ, ভারতে ২৩ দশমিক ৭, পাকিস্তানে ২, নেপালে ২৫ দশমিক ৪ এবং শ্রীলংকায় ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ বনভূমি আছে। সারা বিশ্বেই জনসংখ্যার চাপে বনভূমির পরিমাণ ক্রমেই কমছে। তবে অনেকে মনে করেন, কাগজ ও কাঠের উৎস হিসেবে বনকে শিল্পের অঙ্গীভূতকরণই বন উজাড় হওয়ার প্রধান কারণ। এখন কোনো দেশের কোনো বনকে যতই সংরক্ষিত বলে চিহ্নিতকরণ করা হোক না কেন, ওই বন থেকে কী পরিমাণ কাঠ উৎপাদন হবে তার একটা লক্ষ্যমাত্রা থাকে এবং ওই লক্ষ্যে সরকারিভাবে গাছকাটা চলে; কিন্তু নতুন গাছ সেভাবে লাগানো হয় না। তবে বাংলাদেশে আরও যা হচ্ছে তাহলো সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন উজাড়করণ।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবকে গ্রহণ করেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, বেসরকারি হিসাবে এখন দেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংরক্ষিত বনভূমি, ব্যক্তি পর্যায়ে রোপণ করা গাছপালা, সামাজিক বনায়ন ও উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীসহ নানা উদ্যোগ মিলিয়ে দেশে বনভূমির পরিমাণ এখন বেড়ে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০৩৫ সালের মধ্যেই দেশের মোট ভৌগোলিক এলাকার ২০ শতাংশ বনভূমি এবং সারাদেশের শতভাগ ভূমিকে বৃক্ষ আচ্ছাদিত করতে চায় সরকার। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সামপ্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বন সার্কেলের কয়েকটি বিভাগীয় বন এলাকার কয়েক লাখ একর সংরক্ষিত বনভূমি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবাধ বন ধ্বংস ও অব্যাহত বনজসম্পদ পাচার হয়ে যাওয়ার ফলে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে সবুজ প্রকৃতি ঘেরা চট্টগ্রাম অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য।
ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের বনাঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে বহু প্রজাতির বন্যপ্রাণী। অভিযোগে প্রকাশ, গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম বনাঞ্চল থেকে পাচার হয়ে গেছে হাজার কোটি টাকার কাঠ। ন্যাড়া হয়েছে অসংখ্য সবুজ পাহাড়। পরিবেশ হারাতে বসেছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। ফলে চট্টগ্রাম ও পার্বত্যাঞ্চলে জলবায়ুু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রাকৃতিক বন ছাড়াও শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে সৃজন করা হয়েছিল সরকারি বন বাগান ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল। কিন্তু বন বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা, কর্মচারী ও পাচারকারীরা এসব সমৃদ্ধ বনজ সম্পদ প্রকাশ্যে সাবাড় করে ফেলছে। এতে চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ বন এলাকা পরিণত হয়েছে বিরাণভূমিতে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে যে বিপুল পরিমাণ সরকারী রক্ষিত, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বন এলাকা রয়েছে সেসব রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত জনবল নেই। হাজার হাজার একর বন এলাকা রক্ষার জন্য ৪/৫ জন বন প্রহরী দায়িত্ব পালন করে। যা পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া বন বিভাগের প্রহরীদের কাছে মান্ধাতা আমলের অকেজো অস্ত্রের বিপরীতে বনদস্যুরা ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। যার কাছে বনকর্মীরা পুরোপুরি অসহায়। এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও বন বিভাগীয় কর্মকর্তা–কর্মচারী সরকারী বনজসম্পদ ও বনভূমি রক্ষায় সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বনভূমিকে রক্ষা করতে হলে এই সীমিত ভূখণ্ডে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে বেঁচে থাকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। এই প্রয়োজনে খেয়াল–খুশিমতো উন্নয়নের নামে জনবিরোধী প্রকল্প গ্রহণ করে ভূমি, নদী, খাল, বন ও জলাভূমি দখল এবং দূষণ বন্ধ করতে হবে। পরিবেশবিদরা বলেন, উন্নয়নের নামে জনবিরোধী উদ্যোগ গ্রহণ করা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করাই হয়। বন এলাকায় সব ধরনের শিল্প উদ্যোগ বাতিল করে পরিবেশ দূষণ রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশে আম, জাম, কাঁঠাল ও লিচুর মতো অনেক ফলের গাছ আছে, যাতে ফলও হয় আবার মূল্যবান কাঠও হয়। তাই বন বিভাগের মাধ্যমে দেশব্যাপী দেশীয় জাতের ফলদ গাছ লাগানোর ব্যাপক প্রচারাভিযান চালাতে হবে।