সিঙ্গাপুরে পরিবহন ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি গঠিত হয় ১৯৯৫ সালে। এক দশকের ব্যবধানে সংস্থাটি দেশটির পরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। গ্রাহক সন্তুষ্টির দিক থেকে সিঙ্গাপুরের পরিবহন ব্যবস্থা বিশ্বে এক নম্বর। বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার কথা বলতে গেলে সিঙ্গাপুরের নামটি সামনে চলে আসে। এশিয়ার মধ্যে চীন, জাপান, দুবাই, ইউরোপের সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশের পরিবহন ব্যবস্থা বিশ্বে আদর্শ। প্রতিটি দেশই সড়ক, নৌ, রেল ও আকাশপথের সমন্বয়ে একটি পরিপূর্ণ যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি নির্দেশকও বটে। বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলোর দৃষ্টিতে সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ। সরকারের লক্ষ্য ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, উন্নয়নশীল দেশ বা মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে শামিল হওয়া বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা এখনো অনুন্নতই রয়ে গেছে। মানসম্পন্ন যোগাযোগ ও পরিবহন কোনো ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি আমাদের। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বুয়েটের পুর কৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক এ বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন, উন্নত দেশের জন্য উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলাও জরুরি। তিনি আরো বলেছেন, উন্নত দেশের অনেক সূচক আছে, শুধু জিডিপি দিয়ে উন্নত দেশ হওয়া যায় না। রাস্তায় চলাচল করা গাড়ি দেখে, রাস্তা দেখে, রাস্তার যানজট কিংবা শৃঙ্খলা বিশৃৃঙ্খলা দেখলেই কিন্তু সহজেই বোঝা যায় দেশ উন্নত নাকি অনুন্নত। তার কথার সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। দেশের পরিবহন ব্যবস্থা সরকারি বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। উভয়েরই সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থা একটি বৃহৎ বিষয়। বাংলাদেশের উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা বলতে শুধু অবকাঠামো নির্মাণকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। একথা সত্য, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার জন্য উন্নত ও মানসম্পন্ন অবকাঠামো প্রয়োজন, তবে একমাত্র মানদণ্ড নয়। অন্যান্য মানদণ্ডে উন্নতি ব্যতিরেকে মানসম্পন্ন পরিবহন ব্যবস্থা কল্পনা করা যায় না। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মানদণ্ডের মধ্যে ভ্রমণ বা পণ্য পরিবহনের সময় ও ব্যয়, নিরাপদ ও আরামদায়ক যাত্রা, সড়কের মান, যানজট, চালকের দক্ষতা, দুর্ঘটনার হার, ভাড়া নির্ধারণের সমতা, উৎপাদনশীলতা, পরিবহনের গতি, মূলধন ও পরিচালন ব্যয় পরিবেশ দূষণ, জ্বালানি খরচ, বাস্তুচ্যুতি, আর্থ-সামাজিক প্রভাব, সেবার মান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর কোনো মানদণ্ডেই বাংলাদেশ উন্নীত হতে পারছে না। কিলোমিটার প্রতি ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহন ব্যয় এখানে অনেক বেশি, যার প্রমাণ মেলে বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, পরিবহন ব্যয়ের কারণে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন আমাদের উদ্যোক্তারা, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের বড় বাধাও এটি। যানজটের কারণে সেবাগ্রহীতার সময় ও ব্যয় বাড়ছে। দুর্বল পবিরহন ব্যবস্থার সুযোগে ব্যয় বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত বেশি। জ্বালানি অপচয়ের হারও বাংলাদেশে বেশি, মানহীন সড়কের কারণে উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, লাইফটাইম পার হওয়ার আগেই চলাচলে অযোগ্য হয়ে পড়ছে পরিবহন। বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার নাম অন্তর্ভুক্তির পেছনেও ভূমিকা রয়েছে মানহীন নগর পরিবহন ব্যবস্থার। তাই পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। মাঝে অন্যান্য দেশের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজসের মাধ্যমে রাজধানীর পরিবহন চলাচলে উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত সেটি আলোর মুখ দেখেনি। ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য চলে। উৎসবের সময় এলে এটি আরো বেড়ে ওঠে। তদারকি প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের ভূমিকা এক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয় না। অধিকাংশ বাস ও রেলে সেবার মান খুবই নিম্ন। বসার স্থান ভাঙাচোরা আর নোংরা, জীবাণুমুক্তকরণের কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ে না। পরিবহনগুলো রক্ষণাবেক্ষণে কোনো বিধি বিধানের বালাই নেই। বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থাকে তাই উন্নত করতে হলে একে নিরাপদ, জনগণের সামর্থ্যের মধ্যে ভাড়া নির্ধারণ শূন্য দুর্ঘটনা, ফুটপাত উন্নত করা, পরিচ্ছন্ন ও মানসম্পন্ন পরিবহন সেবা, আরামদায়ক, টেকসই সবার প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যয়ও সময়সাশ্রয়ী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।