পরিচ্ছন্নকর্মীর বড় অংশ কাজে অনিয়মিত

চসিকের ডোর টু ডোর প্রকল্প টানা চার মাসও কাজে অনুপস্থিত অনেকে এবার হচ্ছে না শেষ রক্ষা আসছে শাস্তির আওতায় চাকরি গেল ৪৭ জনের

মোরশেদ তালুকদার | শনিবার , ২৬ জুলাই, ২০২৫ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

ইচ্ছে হলে কাজে আসেন, ইচ্ছে না হলে আসেন না। মর্জিমফিক কাজে যোগ দেয়ার এমন নজির স্থাপন করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্পের আওতায় নিয়োগকৃত শ্রমিকদের একটি বড় অংশ। এদের অনেকে আছেন যারা একটানা তিন থেকে চার মাসও কর্মস্থলে আসেন না। এভাবে অনুপস্থিত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কখনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। চসিকের সাবেক কাউন্সিলরদের ম্যানেজ করেই স্বপদে বহাল ছিলেন তারা। তবে এবার রক্ষা পাচ্ছে না কর্মস্থলে অনুপস্থিত এসব শ্রমিকরা। র্দীর্ঘদিন অনুপস্থিত শ্রমিকদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে চসিক। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ৪৭ জন অস্থায়ী শ্রমিককে চাকরি থেকে অব্যাহতিও দেয়া হয়েছে। এর আগে গত জানুয়ারি মাসেও ৪৮ জন শ্রমিকের একটি তালিকা করলেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আজাদীকে বলেন, পরিচ্ছন্ন শ্রমিকদের প্রতিদিন হাজিরা নেয়া হয়। কর্পোরেশনে ২২শ থেকে ২৩শ পরিচ্ছন্ন কর্মী থাকলেও প্রতিদিন ১৮শ থেকে ১৯শএর বেশি পাই না। ‘কাজ নেই মজুরি নেই’ ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়ায় তারা কর্মস্থলে যেদিন অনুপস্থিত থাকে সেদিনের বেতন পায় না। তবে শ্রমিক অনুপস্থিত থাকলে পরিচ্ছন্ন কাজে সমস্যা হয়, কারণ এমনিতেই শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে ৩ থেকে ৪ হাজার পরিচ্ছন্ন শ্রমিক প্রয়োজন। এদের ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্পের বলা হলেও এরা মূলত পরিচ্ছন্ন কর্মী।

শ্রমিদের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমনও পাওয়া গেছে এক নাগাড়ে ১০/১৫ দিন অনুপস্থিত। এর বেশিও আছে। তিন মাসের অনুপস্থিত শ্রমিকদের একটি তালিকা করেছি। ইতোমধ্যে অনেককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের মেয়াদকালে ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ৬৫ জন শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে ধাপগুলো অনুসরণ করা হয়নি। সাধারণত নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, আবেদনপত্র গ্রহণ ও যাচাইবাছাই শেষে তালিকা তৈরি, নিয়োগ কমিটি গঠন, লিখিত অথবা মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ, নিয়োগ কমিটির সভা এবং ওই সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ, নিয়োগাদেশ, নিয়োগপত্র অথবা যোগদান পত্র প্রদান এবং প্রত্যেক শ্রমিকের বিপরীতে সচিবালয় শাখা থেকে পৃথক পৃথক নথি খোলা। যা ডোর টু ডোর প্রকল্পে শ্রমিক নিয়োগে পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করা হয়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২১ জুলাই জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় অস্থায়ী ভিত্তিতে দুই হাজার পরিচ্ছন্নতা (কাজ নাই মজুরি নাই ভিত্তিতে) কর্মী চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় চসিক। পরবর্তীতে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৭১৭ জনকে নিয়োগ করা হয়। এরপর ২০১৮ সালে ৯৫ জন, ২০১৯ সালে ১৮৩ জন এবং ২০২০ সালে ৬৯ জন নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীতে রেজাউল করিম চৌধুরী মেয়রের দায়িত্ব পালনকালেও বিজ্ঞপ্তি ছাড়া পরিচ্ছন্ন শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়।

জানা গেছে, কর্মরত শ্রমিকরা বিভিন্ন সময়ে সাদা কাগজে আবেদন করেন। যা তৎকালীন মেয়র ‘ব্যবস্থা নিন’ বলে প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা বরাবর মার্কিং করে দেন। এরপ্রেক্ষিতেই তারা কাজ শুরু করেন। অভিযোগ আছে, চসিকের সাবেক স্থানীয় কাউন্সিলদের যোগসাজশে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলেও বেতন পেতেন তারা। অনুপস্থিত থাকলেও ‘অনৈতিক সুবিধা’র বিনিময়ে হাজিরা খাতায় দেখানো হতো উপস্থিত। ডা. শাহাদাত হোসেন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পরিদর্শনে গিয়ে শ্রমিকদের অনুপস্থিত থাকার বিষয়টির প্রমাণ পান।

জানা গেছে, গত ১০ নভম্বের নগরের পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে পরিদর্শনে গিয়ে বরাদ্দকৃত ৫১ শ্রমিকের মধ্যে ২০ জন কর্মস্থলে পাননি মেয়র। ২৫ নভেম্বর জামালখান ওয়ার্ডে অনুপস্থিত পান তিনজন শ্রমিককে। পরবর্তীতে অন্যান্য ওয়ার্ডেও ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’এ গিয়ে শ্রমিকদের অনুপস্থিতির প্রমাণ পান মেয়র। এরপর ৩০ জানুয়ারি ৪৮ জন শ্রমিকের একটি তালিকা করে চসিক। তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতির বিষয়ে নথিও অনুমোদন হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের চাকরিচ্যুৎ করা হয়নি।

পরবর্তীতে একটানা ৩ মাস থেকে ৪ মাসের অধিক সময় কর্মস্থলে অনুপস্থিত শ্রমিকদের তালিকা করা হয়। সম্প্রতি পৃথক তিনটি অফিস আদেশে এরকম ৪৭ জন শ্রমিককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এর মধ্যে একজন স্থায়ী শ্রমিক রয়েছেন। অব্যাহতি পাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ১১ জন ৪ মাস ১২ দিন এবং ৩৫ জন শ্রমিক ৩ মাসের অধিক সময় কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, সাবেক মেয়র আ..ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদকালে ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্পের মাধ্যমে বাসাবাড়ি থেকে সরাসরি ময়লা সংগ্রহ শুরু হয়। যা ওই সময় প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পরবর্তীতে ৩ ধাপে ৪১ ওয়ার্ডে কার্যকর করা হয়েছে প্রকল্পটি। ওই কার্যক্রমের আওতায় বিকেল ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত প্রতিটি বাসাবাড়ি থেকে সরাসরি ময়লা সংগ্রহ করছে চসিকের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। আর তা রাত ১০ টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত নির্দিষ্ট আর্বজনাগারে ফেলা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় বাসাবাড়ি থেকে ময়লাআর্বজনা সংগ্রহে ৯ লক্ষ ছোট বিন ও ৩ হাজার হয় বলেও ওই সময় দাবি করে চসিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদক্ষতা বাড়াতে বন্দর পরিচালনায় আন্তর্জাতিক অপারেটর দরকার
পরবর্তী নিবন্ধবালতির পানিতে পড়ে শিশুর মৃত্যু