চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নানা প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করলেও একটা খাল খননের ব্যাপারে ব্যর্থতার চিত্র ভেসে উঠেছে। নগরের বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এ খাল খনন প্রকল্পটি সাড়ে চার বছরেও শেষ করতে পারেনি। এ খাল খনন প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ইতোমধ্যে প্রায় ১১শ কোটি টাকা ছাড় করেছে মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত মাসে ২৫৪ কোটি সাড়ে ৪৮ লাখ টাকা ছাড়ের অনুমোদন দেয় মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ এ প্রকল্পে অর্থ সংকট নেই। এরপরও চলতি মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৪৫ শতাংশ। এমনকি প্রকল্পটির জন্য প্রস্তাবিত ৫ একর ভূমি অধিগ্রহণও শেষ হয়নি। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
১৭ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ২৪ জুন ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ চার হাজার টাকায় বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন পেয়েছিল। পরবর্তীতে কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি চসিক। এরপর ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর সংশোধন করে প্রকল্পটি এক হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় একনেক। ওই হিসেবে দ্বিতীয় প্রকল্পটি অনুমোদনের ৪ বছর ৭ মাস পেরিয়েছে। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকায় অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে প্রণীত মাস্টার প্লানে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিদ্যমান খালসমূহ প্রশস্তকরণের পাশাপাশি ৩টি নতুন খাল খননের প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ১১ জুন রেকর্ড বৃষ্টিতে নগরীর এক–তৃতীয়াংশ ডুবে যাওয়ার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাস্টার প্লানে প্রস্তাবিত নতুন খাল খননের সুপারিশ করেছিল বিশেষজ্ঞ কমিটি। প্রস্তাবিত খাল তিনটি হচ্ছে– মুরাদপুরের সিডিএ এভিনিউতে মির্জা খালের সমান্তরালে একটি খাল, বহদ্দারহাট খাজা রোডের সমান্তরালে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত একটি খাল ও শীতল ঝর্ণা খাল খননের সুপারিশ করা হয়। এরপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে প্রকল্পটি গ্রহণ করে চসিক।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নানা সময়ে খাল–নালা খননের উদ্যোগ নিয়েছেন। নালাগুলো খনন হয়েছে ঠিক। কিন্তু কোথাও না কোথাও দেখা যাবে আবর্জনা–মাটিতে আবদ্ধ হয়ে আছেন নাগরিকবৃন্দ। আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরি। যেমন বলি– সঠিক পরিকল্পনা হয়নি, বাস্তবায়ন হয়নি, সেবা পাওয়া যায়নি ইত্যাদি। প্রতিটি ক্ষেত্রে যে পরিমাণ নজর দেওয়া প্রয়োজন ছিল, সেটা দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ সঠিক তদারক হয়নি। তার ওপর রয়েছে জবাবদিহির অভাব।
পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন কৌশলের যথেষ্ট অভাব। নীতিনির্ধারকেরা যা করতে চাচ্ছেন, তার প্রায় সবই হচ্ছে। কিন্তু পরিকল্পিত নগরায়ণের ক্ষেত্রে কোথাও যেন ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। কেন এখানে তাঁদের মনোযোগ কম? কেন এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন না? এখানে আমাদেরও ব্যর্থতা রয়েছে। আমরা কেন তাঁদের মনোযোগ এখানে আনতে পারছি না? পরিকল্পিত নগরের ক্ষেত্রে কেন ব্যর্থ হচ্ছে? মনে হয় সর্বোচ্চ জায়গা থেকে ধাক্কা আসা প্রয়োজন।
প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে চট্টগ্রামকে আমরা জলাবদ্ধতামুক্ত ও পরিচ্ছন্ন দেখতে চাই। জলাবদ্ধতা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সাবেক মেয়র মনজুর আলমের সময় একনেকে বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন একটি খাল খননের প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিবছর যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, সে অর্থ দিয়ে ১০টি নতুন খাল খনন করা যাবে। আমরা বারবার ক্ষতিটুকু সয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কাজটি করা হচ্ছে না। গত ২০ বছরে আমাদের কোনো মেয়র মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী কোনো কিছু করতে পারেননি– এমন অভিযোগ করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, চট্টগ্রামের জন্য যে মহাপরিকল্পনা ছিল আগে কোনো মেয়র তা উল্টেপাল্টে দেখেননি। সে অনুযায়ী কাজও করেননি। এখন যা একটু ভাবা হচ্ছে, তার বাস্তবায়নও দরকার।
শুধু চাক্তাই খাল ঠিক করে দিলে জলাবদ্ধতা নিরসন হয়ে যাবে তা নয়। এখানে বড় বড় আবাসন প্রকল্প করা হয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে খাল খনন করা হয়নি। নব্বইয়ের দশকে দেশের নগরায়ণ ও উন্নয়ন একই সঙ্গে দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। পরিকল্পনার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে যুক্ত না করলে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না। তার সঙ্গে চাই আন্তরিক প্রচেষ্টা।