চট্টগ্রামের মতো শহর পৃথিবীতে খুব বেশি নেই মন্তব্য করে বন্দর–পতেঙ্গা আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ বলেছেন, পাহাড়, সাগর, নদী এবং হৃদ মিলে অপরূপ এক শহর চট্টগ্রাম। শহরের দুই থেকে চার কিলোমিটারের মধ্যে নদী ও সাগর। এমন শহরে তো জলাবদ্ধতা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেন এই শহরে জলাবদ্ধতা হচ্ছে তার কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এখানের খালগুলোর অস্তিত্ব নেই। পাহাড়গুলো হরদম কাটা হচ্ছে। এসব ঠিকঠাক করার মতো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে আমাদের আরো চড়া মূল্য দিতে হবে। তিনি বলেন, আইন কেউ মানে না। আইন মানাতে হয়। আইন মানানোর জন্য দৃৃঢ়তা লাগে। যদি সেই দৃঢ়তা না থাকে তাহলে তার ওই চেয়ারে থাকার দরকার নেই।
তিনি গতকাল শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম চেম্বার এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘চট্টগ্রাম মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন। এম এ লতিফ এমপি বলেন, ২০ বছরের জন্য পরিকল্পনা হয় না। ১০০ বছরের পরিকল্পনা করতে হবে। আগে যারা ভুল করেছে, করেছে। এখন আর নতুন করে ভুল করার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, কেউ পছন্দ করুক আর না করুক, এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য যে শেখ হাসিনার মতো একজন ভিশনারি লিডার পেয়েছে। যিনি ব্যবসা–বাণিজ্যের উন্নতিসহ নানা ক্ষেত্রে দেশকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন, যা একদিন কল্পনাও করা যায়নি। সিঙ্গাপুরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বেশি পরিবর্তন চাই। বুঝেও চাই, না বুঝেও চাই। কিন্তু পলিটিক্যাল স্থিতিশীলতা ছাড়া একটি দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমলাতন্ত্রের সমালোচনা করে এম এ লতিফ বলেন, কোনো কোনো আমলার এমন স্পর্ধা হয়েছে যে জনগণের কল্যাণে নেয়া বহু কাজই উনারা ক্ষমতা দেখিয়ে বন্ধ করে দেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে রূপান্তর এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে অবকাঠামোগত উন্নয়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা–চট্টগ্রামের অর্থনীতির লাইফ লাইনকে বর্ধিত করছেন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর কক্সবাজার পর্যন্ত। চট্টগ্রাম হয়ে উঠবে এতদঞ্চলের আন্তর্জাতিক লজিস্টিক হাব। বঙ্গবন্ধু কন্যার দূরদর্শীতায় বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে গড়ে উঠবে বন্দরকেন্দ্রিক বৃহৎ শিল্প কারখানা। সৃষ্টি হবে কোটি মানুষের কর্মসংস্থান। বঙ্গবন্ধু টানেলের দক্ষিণ প্রান্ত পূর্ব আনোয়ারা হতে বাঁশখালী–পেকুয়া–চকরিয়া–ঈদমনি–মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত সরাসরি সড়কটি সম্প্রসারণ করা হলে চট্টগ্রাম থেকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার কমে আসবে। বর্তমান চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের বিশেষত যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী পরিবহনে পারস্পরিক বিকল্প হিসেবে গতিশীলতা বাড়াবে, যা একই সাথে বছরে ২১ হাজার কোটি টাকার জ্বালানি খরচ কমাবে।
তিনি বলেন, দেশের প্রধান বন্দর নগরী ও বিনিয়োগ হাব হিসেবে চট্টগ্রামের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু এখানে কোনো স্থায়ী কনভেনশন সেন্টার কিংবা এক্সিবিশন সেন্টার নেই। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বে টার্মিনালের দক্ষিণ পাশে ২০ একর জায়গায় আন্তর্জাতিক মানের কনভেনশন সেন্টার ও বাংলাদেশ শো’কেস করার প্রস্তাব করেছি। একই সাথে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো চিটাগাং চেম্বার তা বাস্তবায়ন করবে বলে আশা রাখছি। এই বিষয়টিও মাস্টার প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট, উন্নত ও সমৃদ্ধ শিল্পায়ন ও নগরায়নের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামকে রূপান্তরিত করতে মাস্টার প্ল্যান করা হচ্ছে। বাণিজ্য নগরী হিসেবে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে চট্টগ্রাম নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত, আধুনিক আবাসন এবং ট্রান্সপোর্টেশনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প মাস্টার প্ল্যানে রাখার প্রস্তাব করেন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সমগ্র বাংলাদেশ থেকে চট্টগ্রামকে আলাদা করেছে বলে মন্তব্য করে এম এ লতিফ বলেন, এখানে রয়েছে একদিকে পাহাড় অন্যদিকে সমুদ্র। একই সাথে রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্যের কর্ণফুলী নদীও। নদী, পাহাড় এবং সাগরের সাথে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টের দূরত্ব কম হওয়ায় এখানে জলাবদ্ধতার কোনো কারণ নেই। শুধু পরিকল্পনার অভাব। আমরা সমস্ত ওয়েস্টেজ সামগ্রী ফেলে নদী–নালা, খাল–বিল ভরাট করে ফেলছি, যে কারণে জলাবদ্ধতা কমানোর জন্য সড়কের নিচে ড্রেনেজ সিস্টেম করতে পারি। তিনি নগরবাসীর মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করার আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি ওমর হাজ্জাজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ। সভায় বক্তব্য রাখেন চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমেদ, বিজিএমইএর ১ম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বিএসআরএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলীহুসেইন, চেম্বারের প্রাক্তন পরিচালক আমিরুল হক, দি পেনিনসুলা চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান রুহেল, আইএবি–চট্টগ্রাম চেয়ারম্যান স্থপতি আশিক ইমরান, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের প্রাক্তন সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন মজুমদার, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক সদস্য জাফর আলম, লুব–রেফ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ, চেম্বার পরিচালকবৃন্দ মো. রকিবুর রহমান (টুটুল), মাহফুজুল হক শাহ, ইঞ্জিনিয়ার ইফতেখার হোসেন ও মোহাম্মদ আকতার পারভেজ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস, মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন বিষয়ক প্রকল্প পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ইসা আনসারী, বিকেএমইএর পরিচালক ফৌজুল ইমরান খান, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি সালামত আলী, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি সালেহ আহমেদ সুলেমান, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব সভাপতি সালাউদ্দিন মো. রেজা, দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার হাসান আকবর, আন্তঃজিলা মালামাল পরিবহন সংস্থা ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শফিউর রহমান টিপু, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের সহসভাপতি মো. রেজা উদ্দিন খান, জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ (নাসিব) নুরুল আজম খান, রিহ্যাব পরিচালক মাহবুব সোবহান জালাল তানভীর।
এ সময় অন্যদের মধ্যে চেম্বার পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ, বেনাজির চৌধুরী নিশান, মাহবুবুল হক মিয়া, ওমর মুক্তাদির, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেব দুলাল ভৌমিক বক্তব্য রাখেন। মতবিনিময় সভায় মাস্টার প্ল্যানের উপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রফেসর ড. আহসানুল কবির।
বিশেষ অতিথি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, আগের মাস্টার প্ল্যানগুলো হয়েছে বিভিন্ন জরিপের শিট দেখে। কিন্তু এবার মাস্টার প্ল্যান করার আগে জনগণকে এবং স্টেকহোল্ডারদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। যার ফলে আমরা আশা করছি একটি ভালো ও উন্নত মাস্টার প্ল্যান উপহার দিতে পারব। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে ২১টি খাল উদ্ধার এবং দখলমুক্ত করা হয়েছে। বাকি খালগুলোও দখলমুক্ত করা হচ্ছে। জলাবদ্ধতার জন্য সিডিএকে দায়ী করা হলেও নগরীর ১৬৮০ কিলোমিটার খালের মধ্যে সিডিএ মাত্র ৩৮০ কিলোমিটার খালে কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন সিডিএ চেয়ারম্যান। বাকি খালগুলো সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হলে নগরবাসী সুফল পাবে বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন।
সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, নতুন মাস্টার প্ল্যানে পরিবেশবান্ধব আবাসন, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি নগরীতে এমআরটি করার জন্য সার্ভে চলছে বলে উল্লেখ করে বলেন, সিডিএ থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড এমআরটি করার প্রস্তাব দিয়েছি আমরা।
চেম্বার সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে নদীর দক্ষিণ পাড়ে নতুন শহর গড়ে উঠছে। যেখানে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নভিত্তিক নগরায়ন হবে। এই লক্ষ্যে অনেকে জায়গা নিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি স্থাপনা নির্মাণ করছে। কিন্তু সিডিএ নতুন মাস্টার প্ল্যানে নদীর ওপারকেও রাখা হয়েছে। ফলে মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের পূর্বে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয় করতে হবে। কেননা নদীর এপারে সিডিএর আওতাধীন বর্তমান নগরীতে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা, সুনির্দিষ্ট যানবাহনের টার্মিনাল না থাকা এবং জোনভিত্তিক শিল্পায়ন ও নগরায়ন না হওয়ার ফলে সুপরিকল্পিত নগরী গড়ে উঠেনি। তাই আমরা মনে করি বঙ্গবন্ধু টালেনকে ঘিরে যে শিল্পায়ন ও নগরায়ন হচ্ছে তা হবে পরিকল্পিত ও দৃষ্টিনন্দন। এছাড়া নতুন মাস্টার প্ল্যানে চট্টগ্রাম নগরীকে যানজট মুক্ত করার লক্ষ্যে কয়েকটি স্থানে স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণের জন্য জায়গা বরাদ্দ রাখারও আহ্বান জানান চেম্বার প্রেসিডেন্ট।
সভায় বক্তারা চট্টগ্রামে অনেক ভূ–সম্পত্তিসম্পন্ন বিভিন্ন সরকারি সংস্থা বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর, বাংলাদেশ রেলওয়ে, ওয়াসার মতো সংস্থাগুলোর মতামতের পাশাপাশি স্ব–স্ব প্রতিষ্ঠানের মাস্টারপ্ল্যান নতুন মাস্টার প্ল্যানে সংযুক্ত করা, সিডিএকে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্ষমতা বাড়ানো, উন্মুক্ত সবুজ স্থান বাড়ানো, গণযোগাযোগ ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা নিরসনসহ একটি নানন্দিক চট্টগ্রামের জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের পাশাপাশি বাস্তবায়নে সমন্বয়ের লক্ষ্যে সিটি গভর্নমেন্ট বা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করেন।