পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফজিলত

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ১৪ জুলাই, ২০২৩ at ৯:২৯ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র কোরআন শরিফ, কাবা শরিফ এবং পিতামাতার চেহারা মোবারকএই তিন জিনিস শুধু দেখলেই সওয়াব হয়। কোরআন শরিফ তিলাওয়াতে তিনটি ফরজ রয়েছে: হরফ বা বর্ণসমূহ সঠিকভাবে উচ্চারণ করা, হরকত বা স্বরচিহ্ন তাড়াতাড়ি পড়া মাদ বা দীর্ঘস্বর হলে টেনে পড়া। কোরআন শরিফ পড়তে তিনটি কাজ করতে হয়: পবিত্র হওয়া (ফরজ), আউজুবিল্লাহ পড়া (ওয়াজিব) ও বিসমিল্লাহ পড়া (সুন্নাত)। তিনটি কাজে পবিত্রতা প্রয়োজন বা ফরজ হয়নামাজ পড়া, কাবা শরিফ তাওয়াফ করা ও কোরআন শরিফ স্পর্শ করা। কোরআন মাজিদ শিক্ষা করা ফরজ, শিখে ভুলে গেলে মারাত্মক গুনাহ; অশুদ্ধ বা ভুল পাঠ করলে কঠিন পাপের কারণ হতে পারে। তাই কোরআন বিশুদ্ধভাবে শেখা ও সুন্দরভাবে তিলাওয়াত করা জরুরি। যাঁরা পড়তে জানেন না তাঁদের শিখতে হবে, যাঁরা শিখে ভুলে গেছেন তাঁদের পুনরায় পড়তে হবে এবং যাঁরা ভুল পড়েন তাঁদের সহিহ্‌ শুদ্ধ করতে হবে। তিন প্রকার লোকের তিলাওয়াতের ভুল মাফ হবে: যাঁরা সহিহ্‌ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, যাঁরা সহিহ্‌ করার চেষ্টায় রত আছেন যাঁদের সহিহ্‌ শিক্ষার সুযোগ নেই বা সহিহ্‌ ও ভুলের জ্ঞান নেই।

ইসলামের চার খলিফা মাহে রমজানে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতেন এবং কোরআন শরিফ কয়েকবার খতম দিতেন। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.)-মাহে রমজানে সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতেন। মাহে রমজানে সাহাবায়ে কিরামগণ কোরআন শরিফ মুখস্থ করে স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করার জন্য রাতদিন যে অক্লান্ত পরিশ্রম ও কঠোর সাধনা করেছেন তা ইসলামের অনুসারীদের কোরআন শরিফ বোঝার জন্য অনুকরণীয়। ইরশাদ হয়েছে তারা রাত্রিকালে আল্লাহর আয়াত আবৃত্তি করে। (সূরা আলে ইমরান,আয়াত১১৩) কোরআন তিলাওয়াতকারীর জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন আলকোরআনে সুদক্ষ ব্যক্তিগণ সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গী। আর যে ব্যক্তি কোরআন তিলাওয়াত করতে গিয়ে এর উচ্চারণ করা তার পক্ষে কঠিন হওয়ার কারণে বারবার চেষ্টা করে সেই ব্যক্তি দ্বিগুণ সওয়াব লাভ করবে।

পবিত্র রমজান মাসকে সঠিক ও বিশুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াতের মাস হিসেবে ধরে নিতে হবে। না বুঝে যদি এ মাসে কোরআন তিলাওয়াত করেন এতেও প্রতিটি ১০টি করে নেকি দেওয়া হবে। অতএব যাঁরা তিলাওয়াত করতে জানেন না তারা এ মাসে তিলাওয়াত শেখার মাস হিসেবে নির্ধারণ করুন। কোরআন কারিম অধ্যয়ন অনুশীলন ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়েই পাঠানো হয়েছিল প্রিয় নবী (সা.)-কে। হজরত ইবরাহিম (.)-দোয়া করেছিলেনহে আমাদের রব! আপনি তাদের মাঝে তাদের মধ্য থেকে এমন রাসুল পাঠান যিনি আপনার আয়াত পাঠ করে শোনাবেন কিতাব ও হিকমত শেখাবেন এবং তাদের পরিশুদ্ধ করবেন। নিশ্চয়ই আপনি স্নেহশীল ও মহা কৌশলী। (সুরা২ বাকারা, আয়াত: ১২৯)। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করাও ইবাদত এবং তিলাওয়াত শোনা এবং শোনানোও ইবাদত। নবী আকরাম (সা.)-নিজে পাঠ করে সাহাবিদের শোনাতেন এবং সাহাবিদের তিলাওয়াতও শুনতেন। প্রতি রমজান মাসের আগে যতটুকু কোরআন নাজিল হয়েছে তা নবীজি (সা.)-হজরত জিবরাইল (.)-কে শোনাতেন এবং হজরত জিবরাইল (.)-ও তা নবীজিকে শোনাতেন। নবীজি (সা.)-জীবনের শেষ রমজানে উভয়ে উভয়কে দুদুবার করে পূর্ণ কোরআন পাঠ করে শোনান। কোরআন কারিম নাজিলের কারণেই রমজানের ও শবে কদরের ফজিলত, মক্কামদিনার ফজিলত ও কোরআন নাজিলের কারণেই। কোরআনের পরশেই গিলাফ ও রেহালের সম্মান। যে মানুষ যত কোরআনের ধারকবাহক হবে তার সম্মানও তত বেশি হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেন, কোরআনওয়ালাই আল্লাহওয়ালা এবং আল্লাহর খাস পরিবারভুক্ত। যে অন্তরে কোরআন নেই তা যেন পরিত্যক্ত বিরান বাড়ি। হাশরে বিচারের দিনে কোরআন তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে হুজ্জত হবে। (মুসলিম)। যারা কোরআন তিলাওয়াত চর্চা ও অনুশীলন করবে না তাদের বিরুদ্ধে রোজ কিয়ামতে আল্লাহর আদালতে প্রিয় রাসুল (সা.)-অভিযোগ করবেন রাসুল আকরাম (সা.)-বলবেন হে আমার রব ! এই লোকেরা কোরআন পরিত্যাগ করেছিল। (সুরা২৫ ফুরকান, আয়াত : ৩০)

পবিত্র কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানি কিতাব যা সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (.)-এর মাধ্যমে সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাজিল হয়েছে। এরপর কিয়ামত পর্যন্ত আর নতুন কোনো কিতাব ও নতুন কোনো নবী বা রাসুল আসবেন না ; এটিই কিয়ামত পর্যন্ত সব মানুষের জন্য দুনিয়ার শান্তি ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র পথ। কোরআনের অংশবিশেষ পাঠ ব্যতিরেকে প্রধান ইবাদত নামাজও আদায় হয় না। এ জন্যই সহিহ্‌ভাবে কোরআন তিলাওয়াত শিখতে হবে। কমপক্ষে নামাজ পড়তে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু শেখা ফরজে আইন। কোরআন নাজিলের মাস রমজান। আল্লাহতাআলা বলেন রমজান মাস যে মাসে নাজিল করা হয়েছে আল কোরআন মানুষের জন্য হিদায়াতরূপে এবং পথনির্দেশনার প্রমাণ ও সত্যমিথ্যা পার্থক্য নির্ণয়কারী। (সুরা২ বাকারা, আয়াত : ২৮৫)

আলকোরআন তিলাওয়াত করে তা মুখস্থ করা এবং এর নির্দেশানুযায়ী জীবন যাপন করার ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ফরমান যে ব্যক্তি কোরআন তিলাওয়াত করে এবং তদনুসারে আমল করে কিয়ামতের দিন তার পিতামাতাকে এমন এক উজ্জ্বল মুকুট পরানো হবে যা দুনিয়ায় কোনো ঘরের মধ্যে অবস্থানরত সূর্যালোকের চেয়ে অধিক উজ্জ্বলতর হবে। নবী করিম (সা.)-আরও বলেছেন যে ব্যক্তি কোরআন তিলাওয়াত করে এবং তা মুখস্থ করে ফেলে আর এতে বর্ণিত হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম মেনে চলে আল্লাহ তাআলা তাকে বেহেশতে সমাসীন করবেন এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্য থেকে ১০ ব্যক্তির জন্য তার সুপারিশ কবুল করবেন যাদের প্রত্যেকের জন্যই দোজখ নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে আলিফলামমীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফলাম একটি হরফমীম একটি হরফ। এ হলো কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত। অল্প আমলে অধিক সওয়াব তার জন্যই যে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াব আকাঙ্ক্ষা করে। সুতরাং যে কুরআনের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে কুরআনের যথাযথ তদারকি করে না এবং তা দ্বারা উপকৃত না হয় সে ক্ষতিগ্রস্ত। হে আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাজত করুন এবং নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করার তৌফিক দান করুন।

অতএব আলকোরআনের অন্তর্নিহিত মর্মবাণী বুঝতে অতি সহায়ক মাহে রমজানে রোজাদারদের পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত অন্যান্য মাসের চেয়ে বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। যদিও সবার পক্ষে কোরআন শরিফ হিফ্‌জ করা সম্ভবপর নয় তথাপি সাধ্যমতো গুরুত্বপূর্ণ সূরাআয়াত বা তার অংশবিশেষ অর্থ বুঝে শুদ্ধভাবে মুখস্থ করার চেষ্টা করা প্রত্যেকের জন্য অবশ্যকর্তব্য। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎস মহাগ্রন্থ আলকোরআনের শিক্ষার প্রতিফলন ঘটালেই ইহকাল ও পরকালের প্রকৃত সফলতা লাভ করা সম্ভব। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করার এবং কোরআন তেলাওয়াত মনোযোগের সঙ্গে শোনার তাওফিক দান করুন। কোরআনহাদিসে ঘোষিত রহমত, অধিক সওয়াব লাভ এবং পবিত্র কোরআন মাজিদকে আলোকবর্তিকা হিসেবে পাওয়ার তাওফিক দান করুন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদক্ষতা নির্ভর শিক্ষাই দরকার
পরবর্তী নিবন্ধআলোকিত মানুষ রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক