সমপ্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার পরিবহনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বন্দরের র্যাংকিংএ ৩ ধাপ পিছিয়েছে। ‘লয়েডস লিস্ট’র ২০২৩ সংস্করণে শীর্ষ ১০০ বন্দরের তালিকায় বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের স্থান ৬৭তম, ২০২২ সালে প্রকাশিত তালিকায় এর অবস্থান ছিল ৬৪তম। ২০২২ সালের বিশ্বের বন্দর গুলোর কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা হিসাব করে এই তালিকা প্রকাশ করেছে লন্ডনভিত্তিক শিপিং বিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সংবাদ মাধ্যম লয়েডস লিস্ট। তবে এ ক্ষেত্রে বন্দরগুলোর সেবার মান বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তবুও বৈশ্বিক তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের এগিয়ে বা পিছিয়ে যাওয়ার সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন পাওয়া যায়। কারণ দেশে আমদানির বড় অংশ শিল্পের কাঁচামাল এবং রপ্তানির পুরোটাই কনটেইনারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। অর্থাৎ কনটেইনার পরিবহন কমলে শিল্পের উৎপাদন কমে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহন করা হয় ৩২ লাখ ১৪ হাজার একক কনটেইনার। আর ২০২২ সালে পরিবহন করা হয় ৩১ লাখ ৪২ হাজার কনটেইনার, যা আগের বছরের তুলনায় ২.২০% কম।
জানা যায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যে পণ্য পরিবহন করা হয় তার ২৭% কনটেইনারের মাধ্যমে বাকি ৭৩% কনটেইনারবিহীন সাধারণ জাহাজে। সাধারণ জাহাজের (বাল্ক, ব্রেক বাল্ক ও ট্যাংকার) খোলে আমদানি করা হয় সিমেন্ট, ইস্পাত, সিরামিক কারখানার কাঁচামাল, পাথর, কয়লা, ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানি তেল। তবে পরিমাণে এক চতুর্থাংশ হলেও কনটেইনারে বেশির ভাগ শিল্পের কাঁচামাল, বাণিজ্যিক পণ্য ও ভোগ্য পণ্য আমদানি করা হয়।
লয়েডস লিস্ট ২০১৩ সাল থেকে কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা হিসাব করে বৈশ্বিক ক্রমতালিকা প্রকাশ করে আসছে। তখন চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ছিল ৮৬তম। সবচেয়ে ভালো অবস্থান ছিল ২০২০ সালে প্রকাশিত তালিকায়, তাতে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ছিল ৫৮তম।
এদিকে পদ্মা সেতুর কারণে সড়কপথে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের মোংলা বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে চট্টগ্রাম বন্দরের অংশীদারিতে কিছুটা ভাটা পড়ছে। অংশীদারি বেড়েছে মোংলা ও পায়রা বন্দরের।
বর্তমানে দেশে সমুদ্র বন্দর ৩টি–চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা। যার প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় যথাক্রমে ১৮৮৮,১৯৫০ ও ২০১৩ সালে। রাজধানী থেকে এই বন্দরগুলোর দুরত্ব যথাক্রমে ২৬৪, ১৭০ ও ২৭০ কিঃমিঃ। এই তিন সমুদ্রবন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি পণ্য আনা নেওয়া করা হয়। তবে ৯ বছরের ব্যবধানে সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহনে চট্টগ্রামের একচেটিয়া প্রাধান্য কিছুটা কমেছে। এর কারণ হিসাবে অনেকে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের হয়রানিকে দায়ী করেন। জানা যায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষের আচরণ চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে যত রূঢ়, অন্যান্য শুল্ক স্টেশনের ক্ষেত্রে তত রূঢ় নয়। সেটা পণ্যের মূল্য বা এইচ এস কোড যে কোনো বিষয় হোক না কেন। অনেকে অভিযোগ করেন, অসাবধানতা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভুলের জন্য জরিমানা করা নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে তরল ও কেমিক্যাল জাতীয় পণ্য আমদানি করলে চট্টগ্রাম কাস্টমসে অনেকটা বাধ্যতামূলক ভাবে ল্যাব টেস্ট করতে হয়। কিন্তু কাস্টমস হাউজের ল্যাবে পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ল্যাব কর্মকর্তা না থাকায় অধিকাংশ পণ্য বহিল্যাব হতে টেস্ট করাতে হয়। আর যেসব পণ্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের ল্যাবে টেস্ট করানো যায় তার রিপোর্ট পেতে ২৫–৩০ দিন সময় ব্যয় হয়। এতে আমদানি পণ্য শুল্কায়নে অযথা সময় ও অর্থের অপচয় হয়।
অন্য দিকে চট্টগ্রাম বন্দরে কাজ করার ক্ষেত্রে যে রকম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয় অন্যান্য বন্দরে এর ছিটেফোঁটাও নেই। বিশেষ করে হাইস্টার–ক্রেন অপারেটর (যাদেরকে চাহিদামতো উৎকোচ না দিয়ে মালামাল লোড করা যায় না) ট্রাফিক ও সিকিউরিটির লোকজনের জ্বালায় চট্টগ্রাম বন্দরে কাজ করা দায়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো আমদানিকারক যদি পোর্টে তার আনীত মালামাল ডেলিভারি বা কায়িক পরীক্ষার সময় দেখতে চান তবে বন্দরে ঢুকার অনুমতি পান না। ফলশ্রুতিতে দেশের বিভিন্ন এলাকাসহ চট্টগ্রামের অনেক আমদানিকারক চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে মালামাল খালাস না নিয়ে অন্যান্য বন্দর দিয়ে মালামাল খালাস নিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আর এই সুযোগে চট্টগ্রামের অংশীদারি নিতে শুরু করেছে কমলাপুর আইসিডি, পানগাও, মোংলা বন্দর ও নতুন সমুদ্র বন্দর পায়রা।
সদ্য বিদায়ী ২০২২–২৩ অর্থবছরে ঢাকার মিরপুর, গাজীপুর ও সাভার থেকে শতাধিক পোশাক চালান মোংলা দিয়ে রপ্তানি হয়েছে। যেগুলো আগে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হতো। আবার মোংলা বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কয়লা আমদানি। এতে পণ্য পরিবহনে মোংলার অংশীদারি বাড়ছে। অন্যদিকে এক দশক আগে প্রতিষ্ঠিত পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্র বন্দরের বহির্নোঙরে স্থানান্তরের মাধ্যমে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা ও পাথর আমদানি হচ্ছে। মোংলা ও পায়রায় নতুন দুটি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। টার্মিনাল দুটি নির্মাণ হলে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে মোংলা ও পায়রার অংশীদারি আরো বাড়বে বলে বন্দর দুটির কর্মকর্তারা আশা করছেন। অন্য দিকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের হিস্যা আরো কমবে।
দেশে গত ৫২ বছর ধরে বন্দর ভেদে আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহনে চলছে জোয়ার ভাটা। সব কটি সরকারি পরিচালনাধীন বন্দরের মধ্যে থাকছে এই প্রতিযোগিতা। তবে নতুন বন্দরের প্রকল্প গুলো চালু হলে এই জোয়ার ভাটা নতুন মাত্রা পাবে। কারণ সরকারি পরিচালনার বাইরে বেসরকারি খাতও যুক্ত হবে বন্দর পরিচালনায়। যেমন ২০২৬ সালে মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল চালু হলে একটা বড় অংশীদারি যাবে সেখানে। আবার চট্টগ্রাম বন্দরের অদূরে বে টার্মিনাল চালু হলে সেখানেও বেসরকারি খাত যুক্ত হবে বন্দর পরিচালনায়।
চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বশেষ মহাপরিকল্পনায় প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, নতুন প্রকল্পগুলো চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের মূল স্থাপনায় কনটেইনার পরিবহনের অংশীদারি অনেকাংশে কমবে। ২০৪৩ সাল নাগাদ চট্টগ্রাম বন্দর দেশের মোট কনটেইনারের মাত্র ৪৯–৫০% পরিবহন করবে। চট্টগ্রামের মূল বন্দরের বাইরে প্রস্তাবিত বে টার্মিনাল ও মহেশ খালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের টার্মিনাল, মোংলা ও পায়রা বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের অংশীদারি বিস্তৃত হবে, যা কাছাকাছি শিল্পাঞ্চলে পণ্য পরিবহনে সুযোগ তৈরি করবে।
এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, কর্ণফুলী নদীর এক চ্যানেলের উপর সারা দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের চাপ কমাতে সরকার অনেকগুলো বন্দর প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব বন্দর এখন দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভার নিতে শুরু করেছে, এটা ভালো দিক। আবার এক বন্দরের উপর নির্ভরশীলতা দিয়ে দেশের সব অঞ্চলে উৎপাদনমুখী শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। তাই বিকল্প হিসেবে মোংলাকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া দক্ষিণবঙ্গে যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে, সেখান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহন করা হবে সময়সাপেক্ষ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় রাজধানী ও তার আশপাশের ব্যবসায়ীরা সহজেই মোংলা ব্যবহার করতে পারছেন। এতে পায়রা, মোংলা, মাতারবাড়ীকে কেন্দ্র করে এবং বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীকে সংযুক্ত করে বন্দর কেন্দ্রিক উন্নয়নের সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হবে। ফলে একদিকে লজিস্টিকস ব্যয় কমবে এবং অন্যদিকে পণ্য আনা নেওয়া দ্রুত করা যাবে–যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট