বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হলো পৃথিবীর গভীরতম পাইলের উপর প্রতিষ্ঠিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে দেশ ও তার সরকার বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে সরকার প্রধান যে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তার উত্তরণ পূর্বক এ প্রকল্পকে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছানোর অদম্য সাহস এবং নেতৃত্ব শক্তিকে প্রথমে ধন্যবাদ দিতে হয়।
পদ্মা সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের অনুন্নত আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন সাধিত হবে। এ সব স্থানে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সমূহ, ইতোপূর্বে স্থানীয়ভাবে বিক্রি করতে হতো। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অধিক ছিল বিধায় কৃষকেরা তাদের উপযুক্ত মূল্য পেত না। এ সব কৃষিপণ্য সমূহ এখন অতি সহজে ঢাকা এবং এর দূরতর স্থান সমূহে ক্রেতাদের কাছে পৌছে যাবে। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় পক্ষ লাভবান হবে। এ সুবিধা উৎপাদকদের উৎসাহিত করবে। আধুনিক পন্থায় অধিক শস্য ফলানোর ব্যবস্থা গৃহীত হবে। দেশে কৃষি বিপ্লব সৃষ্টিতে তারা অবদান রাখতে পারবে।
পদ্মাসেতু নির্মাণ আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই এর পরিকল্পনাকারীরা মতামত দিয়েছিলেন যে, এ বিশাল প্রকল্প সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ, প্রয়োজনীয় মেরামত, যাতায়াতের শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদির প্রয়োজনে বিভিন্ন বিভাগ ও প্রশাসনের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের স্থায়ী নিযুক্তি আবশ্যকীয় হবে। এসব কর্মচারী কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের দৈনিক প্রয়োজন মিটাতে সেতুর উভয় পারে সৃষ্টি হবে দৃষ্টি ক্ষুদ্র শহর। যেখানে থাকবে অফিস ভবন, ল্যাবরেটরি, মসজিদ, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ডুপ্লেক্স ভবনের মোটেল, পানির ট্যাংক বিদ্যুতের সাব স্টেশন এবং অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। সরকারিভাবে নিযুক্ত ব্যক্তিরা ছাড়া আর সবাই হবে স্থানীয় জনগণ, ইহাতে স্থানীয় বেশ কিছু মানুষের কর্মস্থান হবে।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর কারণ দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অংশের অনুন্নত স্থান সমূহে ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পায়নের পরিকল্পনা বৃদ্ধি পাবে সর্বস্তরের মানুষের জন্য কর্মস্থানের সুযোগ এবং পাশাপাশি শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থানের সংস্থান এবং সামাজিক উন্নয়নের ধারা গতি লাভ করবে। দারিদ্র দূরীকরণ সহজতর হবে। বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু চালু হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর দারিদ্র্যের হার অনেক হ্রাস পেয়েছে। কৃষির বহুমুখী করণ হয়েছে। শিল্পায়ন গতি লাভ করেছে।
বঙ্গবন্ধু সেতুর চাইতে পদ্মা সেতু দেশের অর্থনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রাণকেন্দ্র ঢাকার অনেক কাছে অবস্থিত এবং দেশের বৃহত্তম বন্দর চট্টগ্রামের সাথে সহজতর যোগাযোগের মধ্যে স্থিত বিধায় দেশের বৃহত্তম এ সেতু জন সাধারণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে অনেক বেশী।
বাংলাদেশের সামগ্রিক ভূ-খণ্ডটিকে এর বৃহৎ নদী সমূহ কয়েকটি বৃহৎভাগে ভাগ করেছে। তার মধ্যে মূল প্রধান ভাগটি পদ্মা যমুনার উত্তর ও দক্ষিণ ভাগ এর মধ্যে দক্ষিণ ভাগটি হলো বাংলার আসল শস্য ভান্ডার। এ শস্য সমূহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো বাঙালির প্রধান খাদ্য চাল আর ডাল।
দেশের জনগণের মূল খাদ্যের অপরিহার্য অংশ এ দুই দানাদার অপনশীল কৃষিপণ্য, উৎপাদনস্থল হতে দেশের অধিকাংশ স্থানে, এমনকি শেষ জেলা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জিলা পর্যন্ত পৌঁছত বঙ্গবন্ধু সেতু এবং মাওয়া জজিরা অর্থাৎ প্রায় ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত পদ্মনদীর উপর দিয়ে ফেরি পারাপারের মাধ্যমে। ট্রাক ভরতি এ ভারী পণ্য ফেরির মাধ্যমে পারাপার ছিল অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ ও সময় সাপেক্ষ। এখন তা অনেক নিরাপদ এবং ১০/১৫ মিনিটের ব্যাপার। এ সেতু রাজধানীর অতি সন্নিকটে অবস্থিত বিধায় ঢাকা-চট্টগ্রাম-কঙবাজার হাইওয়ে দিয়ে এসব পণ্য অতি সহজে দেশের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।
আবার বাংলাদেশ লবণ উৎপাদনের একমাত্র স্থান হলো কক্সবাজার, এখান থেকে চট্টগ্রাম শহর সংলগ্ন বন্দর হয়ে এ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় খাদ্য বস্তু দেশের সর্বত্র পরিবাহিত হতো নদী পথে, স্বাভাবিকভাবেই ধীর গতিতে। বর্তমানে, তা যত দিনে লক্ষস্থলে পৌঁছত তত ঘন্টায় ঐ স্থলে পৌঁছে যাবে।
বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে তার বাংলাদেশ অংশ প্রাকৃতিক সমপদের স্বর্ণ খনি, বিশেষ করে এর মহীসোপান অংশ বিশেষজ্ঞদের মতে অসংখ্য সুস্বাদু প্রকৃতির মৎসের চারণভূমি, প্রায় সকল প্রকার সামুদ্রিক মৎস্য আয়োডিন সমৃদ্ধ হয়ে থাকে, যা মানুষের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় উপাদান, এর অভাবে গলগন্ড ও অন্যান্য রোগ সৃষ্টি হয়। মিষ্টি পানির মাছে ইহা থাকে না। পদ্মা সেতুর কল্যাণে এ প্রয়োজনীয় সৎস সম্পদ দেশের সর্বত্র পৌঁছে যেতে পারবে সহজে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে এখনও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনায় অনুসন্ধান চলছে। তা সফল্য লাভ করলে গ্যাস অতি সহজে পদ্মার অপর পারে পৌঁছে যেতে পারবে। বর্তমানে মহেষখালি সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর দিয়ে গ্যাস এবং তেল আমদানী হচ্ছে, বৃহৎ সমুদ্রপোত এর মাধ্যমে। এ সব আমদানীকৃত গুরুত্বপূর্ণ পণ্য সমূহ পদ্মার অপর পারে শিল্প উন্নয়নে গতি সঞ্চার করবে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালীর পায়রাতে সমুদ্র বন্দর হচ্ছে। আর মংলাবন্দরতো রয়েছেই যা এত দিন একটু স্তিমিত ছিল, সেখানেও কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে। অধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। পদ্মার ওপারে একটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর হওয়ার কথা রয়েছে এসব প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে সারাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি সঞ্চারিত হবে। পদ্মা সেতুর দক্ষিণাঞ্চলে স্থাপিত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মংলা পায়রা সমূদ্র বন্দর দিয়ে ভারতের আসামে প্রদেশ, ভারতের উত্তরে হিমালয়ের সন্নিকটে নেপাল, ভূটান প্রভৃতি রাষ্ট্র এমন কি এ সব রাষ্ট্র সংলগ্ন চিনের অংশেও উপরোক্ত সমুদ্র বন্দর দুটোর মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় আমদানি রপ্তানি কাজ পরিচালনা করতে পারবে। এসব কর্মকাণ্ডের মেরুদণ্ড হলো পদ্মা সেতু। উপরোক্ত দেশ সমূহের সাথে বাংলাদেশের বন্দর সমূহ ব্যবহারের চুক্তি হলে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক। ভারতের আসাম প্রদেশ, এবং চিনের আসাম ও নেপাল সীমানায় অবস্থিত অংশ, তাদের যে কোন নিজস্ব বন্দর হতে অনেক দূরে অবস্থিত।
স্বাভাবিকভাবে এসব বন্দর দিয়ে আমদানী রপ্তানি বাংলাদেশের যে কোন বন্দর বিশেষ করে মংলা পায়রা বন্দরের চেয়ে অনেক বেশী ব্যয় সাপেক্ষ। আর নেপাল ও ভুটানে তো কোন সমুদ্র বন্দর থাকার প্রশ্নই ওঠেনা। তাই এ চারটি দেশের সাথে আমাদের বন্দর সমূহ ব্যবহারের চুক্তি হলে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক। এতে তাদের এসব কার্যের ব্যয় সংকোচিত হবে আর বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা লাভ করবে। তাছাড়াও এ কারণে এসব দেশে বাংলাদেশের জনপ্রিয়তা বাড়বে। এসব দেশের পর্যটকেরা আমার দেশে ভ্রমণ করতে উৎসাহী হবে। তাদের সাথে আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক সখ্য বৃদ্ধি পাবে। স্বাধীন বাংলাদেশের সম্মান বিশ্ব বাজারে আরো বৃদ্ধি হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্যতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সম্পর্কে তারা আরও অধিক অবগত হবে। বিশ্বের দরবারে এদেশ ও জাতির মর্যদা বৃদ্ধি পাবে।
দেশের ভিতরে ও বাহিরে বহু দুর্লঙ্ঘনীয় বাধার প্রাচীর অতিক্রম করে, বহু বৃহৎ শক্তির হুমকি উপেক্ষা করে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেশের এ বৃহত্তম উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের সুফল জনগণের দ্বার প্রান্তে পৌঁছায়ে দিয়েছেন। তার এ বিরল কৃতিত্বের জন্য জনগণ তার কাছে কৃতজ্ঞ। এ কৃতজ্ঞতার চিহ্ন স্বরূপ জনগণের পক্ষ হতে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাহেব পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনা সেতু দেওয়ার প্রস্তাবটি মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছে পেশ করেছিলেন। তিনি তা নাকচ করে দেন। আবার ওবায়দুল কাদের সাহেব জাতীয় পরিষদে ও প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন যা পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের সমর্থন লাভ করে। কিন্তু এ পর্যায়ে ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাত নেড়ে তা নাকচ করে দেন। ওবায়দুল কাদের সাহেব সুযোগ্য পাত্রকে তার যোগ্যতার স্বীকৃিত দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে যোগ্যজন প্রমাণ করে দিলেন তিনি ঐ সবের অনেক উর্ধ্বে।
যাক আমরা পদ্মা সেতুর কথা বলি। এ সেতুটির আয়ূস্কাল নাকি একশত বছর। তবে তা হয়ত আরো কিছু বেশী দিন টিকে থাকতে পারে, যেমন কর্ণফুলীর রেল সেতু যা কালুরঘাট সেতু নামে পরিচিত, একশত বছরের জন্য নির্মিত এ সেতুর উপর, বহু অন্যায় অত্যাচার হওয়ার পরে কোন রকমে এখনও তা বেঁচে আছে। এ অত্যাচার হবে না পদ্মা সেতুর উপর পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে যে সব যান বাহন চলবে তার উপর যে টোল নির্ধারিত হয়েছে তা অত্যধিক হয়েছে বলে মনে হয়। যেহেতু এ টোল গুলোর মধ্যে শুধু ব্যক্তিগত গাড়ির (প্রাইভেট কার) মালিকেরা ছাড়া অন্যান্য যান বাহনের উপর নির্ধারিত টোলটা পড়বে সাধারণ যাত্রীদের ওপর, যান বাহনের মালিকেরা যাত্রীর ওপর এর অস্বাভাবিক সুযোগ গ্রহণ করবে, তাই একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমার বিনীত নিবেদন টোল চার্জটা ইতিপূর্বের মাওয়া জজিরা ফেরি খরচের সমান রাখা হোক, অবশ্য একমাত্র প্রাইভেট কারগুলো ছাড়া, তারা এ ভার বহণ করতে সক্ষম।
পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে, বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে, সুতরাং এর নির্মাণ ব্যয় কোন বিশেষ দেশ বা প্রতিষ্ঠানকে শোধ করার কোন তাড়া নেই। এতে যা আয় হবে তা সরাসারি দেশের অর্থ ভাণ্ডারে পৌঁছবে, আর পদ্মা সেতুর উপর ধার্যকৃত অর্থই এ সেতুর একমাত্র আয় নয়, এর অবস্থান দেশের যে বহুমুখী উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধন করবে তার সব কিছুই এর কৃতিত্বের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি যোগ্য।
২৫ শে জুন পদ্মাসেতুর শুভ উদ্বোধনের দিন। আমাদের জাতির পিতার রাজনৈতিক জীবনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিন আছে। তার ছয়দফা ভিত্তিক আন্দোলন আরম্ভের দিন। স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জীবনে এ পর্যন্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো-তাঁর দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণের পরে দেশের প্রচলিত আইনে তার পিতার হত্যাকারী দানবদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনানল) আইন অনুযায়ী দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা, আর পদ্মার উপর নিজস্ব অর্থায়নে বৃহৎ, সুদৃশ্য সেতু নির্মাণ। আমরা এ যুগের জনগণ এমন কি আজ যে শিশু পৃথিবীর মুখ দেখল সেও যখন পৃথিবীতে থাকবে না, তখনও পদ্মা সেতু থাকবে, নীরবে জন মানুষের সেবা করে যাবে আর মানুষের হৃদয়ে প্রজ্বলিত রাখবে বাঙালীর মহান নেত্রীর পুণ্য স্মৃতি। ধন্য তুমি জাতির পিতার সার্থক কন্যা জনগণের স্নেহময়ী মাতা শেখ হাসিনা, ধন্য এ দেশ যে তোমাকে বক্ষে ধারণ করেছে। ধন্য তোমার জন্মদাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, ধন্য সে মা যিনি ক্রোড়ে ধারণ করে লালন করেছেন তোমাকে।
লেখক : সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, বায়তুশ শরফ আঞ্জুমান ইত্তেহাদ বাংলাদেশ।