‘পদ্মপাতার জল’ ও লেখকের সংবেদনশীলতা

অমিত সরকার | সোমবার , ১৮ মার্চ, ২০২৪ at ৫:১৩ পূর্বাহ্ণ

নন্দিত কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক বিচিত্রা সেনের গল্পউপন্যাস পড়ছি কয়েক বছর ধরে, গল্পকার ইতিমধ্যেই সুন্দর,সাবলীল এবং নিজস্ব ধারার গদ্য সৃষ্টি করে পাঠক মহলে প্রিয়মুখ হয়ে উঠেছেন। ২০২৩ সালে একুশের বই মেলায় প্রকাশিত তাঁর নতুন গল্পগ্রন্থ ‘পদ্ম পাতার জল’ নিয়ে আমার কিছু অনুভূতি আজ পাঠকের সাথে শেয়ার করবো। এটি লেখকের পঞ্চম গল্পগ্রন্থ।ছোট বড় মাঝারি ষোলোটি গল্প অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।

বিচিত্রা সেনের গল্প তৈরীর বড় শক্তি হচ্ছে তিনি একজন প্রবল সংবেদনশীল নারী। সঙ্গত কারণে সমাজে নারীর বহুরৈখিক অবস্থানকে তিনি সহজেই চিহ্নিত করতে পারেন, প্রমাণ তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্প উপন্যাসের কেন্দ্রীয় এবং পার্শ্ব চরিত্র মোটামুটি ভাবে নারীই। এইবার তিনি এই ধারা থেকে বের হয়ে এসে বিচিত্র বিষয়ের ভেতরে গমন করছেন। নারী প্রধান কাহিনি তো আছেই, সেই সাথে অনেকগুলো পুরুষ চরিত্র গল্পের প্রধান উপজীব্য করে তাদের যাপন চিত্র এঁকেছেন নানা গল্পে।

যেমন ‘পদ্মপাতার জল’ গল্পের কথা বলি না কেন, গল্পের মূল চরিত্র প্রতুল, লেখিকার ভুলে যাওয়া পাড়ার এক বাল্যবন্ধু।অনেকদিন পর রাস্তায় হঠাৎ দেখা হলেও ভীষণ বদলে যাওয়া প্রতুলকে চিনতে তাঁর বেগ পেতে হয়। এক সময়ের প্রবল প্রেমিক, নায়কোচিত পোশাকে ঘুরে বেড়ানো এমন দুর্দান্ত তরুণ বন্ধুর রোগেশোকে পর্যুদস্ত হওয়া, চরম পরিবর্তন মনে নানা ধরনের ভাবনার উদয় করে। অন্তঃক্ষরণ, ক্ষণস্থায়ী জীবনের উপলদ্ধি, প্রতুলের প্রতি মর্মবেদনার লেখচিত্র নির্মাণ করছেন এই গল্পে ।তেমনি ভাবে শেষ রাত্রির লেগুনাগল্পে প্রান্তিক মাছ ব্যবসায়ী লোকমান মূল চরিত্র। ছিনতাইকারীর কবলে পড়া জীবনের করুণ ট্রেজেডির খবর পেতে পারেন এই গল্পে। জ্ঞান হারাতে হারাতে লোকমানের মনে পড়ে তার বৌ আর দুমেয়ের কথা।নিয়ন বাতিগুলোর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতে থাকতে এক সময় লোকমানের দুচোখে গভীর অন্ধকার নেমে আসে। নিয়তির নির্মমতায়, মানুষরূপী পশুর পাষণ্ডতায় পাঠকের চোখ আর্দ্র হতে বাধ্য।

পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিবেশে যুদ্ধে আত্মত্যাগী পরিবারের নিরাপত্তার সংকট, স্বাধীনতার মূল্যবোধের বিপরীত পরিস্থিতির বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদের মানবিক প্রতিবেদন “সেই ছবিটা” গল্পের মূল সুর। ড্রয়িং রুমে বঙ্গবন্ধুর ছবি থাকবে কি থাকবে না এই নিয়ে বিধবা মায়ের দুশ্চিন্তা আর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তার দুই সন্তানের বলিষ্ঠ সংলাপ থেকে উঠে আসে এক ক্রান্তিকালের ছবি।।ছোট আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প, সেই সাথে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় গণতন্ত্রের চেতনানাশক বোবাধরা এক সময়কে।

ফেরারি মনটা তাহার’ একটি ব্যতিক্রমধর্মী গল্প। শ্রমজীবী দম্পতির একমাত্র মেয়ে মালা। তার প্রথম বিয়ে যখন ঠিক হয়েছিল,তখন তাকে সিনেমার নায়িকার মতো উথালপাথাল কল্পনার রাজ্যে ভেসে যেতে দেখি। তার কল্পনা প্রথম ধাক্কা খায় যখন দেখে তার বিয়ের অনুষ্ঠান একেবারেই অনাড়ম্বর । দ্বিতীয় ধাক্কাটি আসে যখন বিয়ের পর দেখে তার স্বামীটি বোবা। কিছুদিন সংসার করার পরে আবার পালিয়ে বিয়ে করে, এই বার স্বামীটি তাকে রেখে পালায়। তৃতীয়বার মৃত বাচ্চা জন্ম দেয়ার জন্য শ্বাশুড়ী পিটিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়, চতুর্থবার বিয়ে করার পর আবার যখন বাবা মার কাছে ফিরে আসে, অশিক্ষিত মা বুঝতে পারেনা জীবনে তার কিসের অপূর্ণতা ? পাঠকও চিন্তায় ক্লিষ্ট হবেন মালার চার চারবার বিয়ের পরিণতি দেখে।

মল্লিক বাড়ির বরই’ গল্পে কাঁটাতারের সীমান্ত গলিয়ে বরই চুরি করতে গিয়ে দুই বালকের কাণ্ডকীর্তি পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে নিজেরই অতীত। ধরা পড়ার পর দুই বালকের শিশু মনস্তত্ব পাঠক সহজেই উপভোগ করবেন, আর ভাবনায় ভেসে উঠবে সে সময়কার পাড়ার সার্বজনীন স্নেহময়ী এক দিদার মুখচ্ছবি। ‘পুষির কাণ্ড’ এবং ‘রীমার কীর্তিশৈশবস্মৃতি এবং শিশু মনস্তত্ত্ব নির্ভর দুটি গল্প, যা ছোট বড় সবারই ভালো লাগবে।

লাগামহীন বণিকবৃত্তি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, এক প্রকার আরোপিত পরিবেশ এবং অসচেতনতার কবলে আমাদের শহরগুলো। খেলার মাঠ, খাল বিল, প্রাকৃতিক আধার যা অবশিষ্ট আছে তার আর কোন কিছুই রেহাই পাচ্ছেনা। প্রতিবাদের ভাষা যদি কলম হয়ে থাকে তার সার্থক রূপায়ণ ঘটেছে ‘স্লোগান’ গল্পটির মধ্য দিয়ে। গল্পকার দেখিয়েছেন সিআরবিতে হাঁটতে আসা এক নির্বিবাদী অসুস্থ মা ও তার ছেলে কীভাবে পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছেন। যাঁদের মুখে ধ্বনিত হয়েছে ’মাফিয়া তুই দূর হয়ে যা / সি আর বি মোরা ছাড়ছিনা’স্লোগান।

গল্পের বিষয়বৈচিত্র্যে প্রেম বিষয়ক কোন গল্পের ঠাঁই হবেনা,সেটা পাঠক হিসাবে মেনে নেওয়া একপ্রকার কঠিন। প্রেমবঞ্চিত মানুষের জন্য প্রেমের গল্প তাই একধরনের আশীর্বাদ। ‘একটি সংবাদ এবং তারপর ..’ গল্প টি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নীরার সাথে পারিবারিকভাবে পরিচিত মুরাদের গড়ে ওঠা প্রেম নিয়ে। যা পরবর্তীতে বিচ্ছেদে রূপ নেয় যখন নীরাকে বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে অন্য ছেলেকে বিয়ে করতে হয়। আর আট দশটা বাঙালি নারীর মত সব কিছু কমেপ্রামাইজ করে জীবনের পড়ন্ত বেলায় নিজেকে মনে করে একজন সফল নারী। কিন্তু হঠাৎ টেলিভিশনের একটি সংবাদ দেখে তার সেই আত্মসন্তুষ্টির দেয়াল ভেঙে পড়ে। সংবাদটি ছিল প্রাক্তন প্রেমিকের সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে প্রমোশন পাওয়ার সংবাদ এবং সেই সাথে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা তাঁর হাস্যোজ্জ্বল এবং গরবিনী স্ত্রীর যুগল ছবি। প্রেম যেন জেগে উঠে স্টোর রুমে অবহেলায় রক্ষিত পুরানো কোন সিন্দুক থেকে। প্রেমিকের অপরিচিত স্ত্রীর প্রতি ব্যাখ্যাতীত হিংসা,বিরাগ মানসিকভাবে বেসামাল করে তোলে গল্পের নায়িকাকে।তার মনের অন্তর্গত দ্বন্‌দ্েবর ঘোলাটে পরিস্থিতির খোঁজ পেতে হলে আপনাকে পুরো গল্পটি পড়তে হবে।

এ ধারারই আরেকটি গল্প ‘তুমি রবে নীরবে’। যে প্রেম বিচ্ছেদ বয়ে আনে অকারণে, প্রেমিকের পক্ষ থেকে সেটা ব্যাখ্যাবিশ্লেষণহীন রয়ে যায় দীর্ঘদিন। হঠাৎ একদিন সে প্রেমিক তার শহরে এসে দেখা করতে চায়। যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যার আকুতি জানায়। প্রকাশক : দেশ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; অমর একুশের বইমেলা ২০২৩।

লেখক : প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপ্রতিদ্বন্দ্বী চেম্বার নেতা পরিমল সাহা
পরবর্তী নিবন্ধকুয়েতে বাংলাদেশ ফুটবল দল