দুজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এবং মানবিক বিভাগ থেকে পাস করা একজন সুপারভাইজার মিলে সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিকো অক্সিজেন লিমিটেড পরিচালনা করতেন বলে জানিয়েছেন কোম্পানির এমডি মো. মামুন উদ্দিন। গতকাল দুপুরে সার্কিট হাউসে চট্টগ্রাম জেলার ভারী ও মাঝারি শিল্পপ্রবণ এলাকার দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য দেন।
গত শনিবার বিকালে ওই কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত ৭ জনের প্রাণ গেছে। তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে লোহার টুকরো প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে উড়ে গিয়ে। এখনও চিকিৎসাধীন জনাবিশেক মানুষ। খবর বিডিনিউজের। গতকাল সভার শুরুতে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জানতে চান, কত সাল থেকে সীমা অক্সিকো অক্সিজেন লিমিটেড ব্যবসা করছে? জবাবে কোম্পানির এমডি মামুন বলেন, ১৯৯৬ সালে এটা প্রতিষ্ঠিত। আমার বাবা আহমদ শফী প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে চালু আছে। সরকারি সব কমপ্লায়েন্স মেনেই কারখানাটা চালু রেখেছি। কী কারণে হঠাৎ করে পরশু দিন ব্লাস্ট হয়েছে আমরা এখনও… ইয়ে করতে পারতেছি না। তদন্ত কমিটি গতকাল পরিদর্শন করে এসেছে। উনারা তদন্ত করলেই আসল কারণটা বুঝতে পারবেন।
সেখানে কত শ্রমিক কাজ করতেন এবং কী উৎপাদন হতো? এ প্রশ্নের উত্তরে মামুন উদ্দিন বলেন, ওই শিফটে ১৪–১৫ জন শ্রমিক ছিল। দুজন অপারেটর ছিল। অ্যাডমিনে দুজন ছিল। একজন সুপারভাইজার ছিল। সব মিলিয়ে ১৯ জন।
তাহলে এত লোক কীভাবে হতাহত হলো? এমন প্রশ্নের উত্তরে সীমা অক্সিজেনের এমডি বলেন, অনেক পথচারী আহত হয়েছেন। প্ল্যান্টে কী উৎপাদন করা হয়? জেলা প্রশাসকের এই প্রশ্নের জবাবে মামুন বলেন, আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন প্রস্তুত করি। আমি অ্যাকাউন্টিংয়ে মাস্টার্স করেছি।
ডিসি ফখরুজ্জামান জানতে চান, আপনাদের ওখানে ইঞ্জিনিয়ার বা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কেউ আছেন? যারা প্ল্যান্টটি পরিচালনা করেন? জবাবে মামুন বলেন, অপারেটররা ডিপ্লোমা হোল্ডার। উনারা ২৭ বছর ধরে ওই প্ল্যান্টটা চালাচ্ছেন। সেজন্য এক্সপেরিয়েন্স আছে।
কীভাবে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট চালাচ্ছে? জানতে চান জেলা প্রশাসক। মামুন তখন বলেন, এটা তো দুর্ঘটনা। এটাতে কারও হাত নেই। কেন হয়েছে জানি না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভালো বলতে পারবেন এটা কী জন্য হয়েছে।
এ সময় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার মো. সোলায়মান জানতে চান, প্ল্যান্টটি (যন্ত্রপাতি) চীন থেকে ইমপোর্ট করা। ইন্সটলেশনের পর প্রকৌশলীরা আর কখনও এসেছিলেন? আপনারা কীভাবে মাত্র ২ জন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এবং মানবিক থেকে পাস করা একজন স্টুডেন্ট (সুপারভাইজার) দিয়ে একটা অক্সিজেন প্ল্যান্ট চালাচ্ছেন?
জবাবে মামুন উদ্দিন বলেন, চীন থেকে সাপ্লাই দেওয়ার পর কমিশনিং এবং প্রোডাকশন পর্যন্ত প্রায় তিন মাস উনারা এখানে ছিলেন। এরপর আরও দু মাস থেকে যারা অপারেটিং করবে, তাদের ট্রেনিং দিয়েছেন। তারপর আর আসেননি। উনারা প্রায় (ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও সুপারভাইজার) ২০ বছর ধরে চালাচ্ছিলেন।
এরপর জেলা প্রশাসক বলেন, প্রাথমিকভাবে যতুটুকু জেনেছি আপনাদের ওখানে অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে জিনিসপত্র রেখেছিলেন। অ্যাসেম্বলিং পয়েন্ট, সেফটি প্ল্যান্ট কিছু ছিল না।
সীতাকুণ্ড থানার ওসি মো. তোফায়েল আহমদ বলেন, ঘটনার দিন যার অক্সিজেন কলাম পরিচালনার কথা ছিল, সে অনুপস্থিত ছিল বলে জানতে পেরেছি। অন্য একজনকে দিয়ে সেটি চালানো হচ্ছিল। এভাবে দক্ষ লোকের পরিবর্তে অন্যদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালালে কী হয় তা তো দেখাই যাচ্ছে। সাতজনের প্রাণ গেছে। যার গেছে সেই জানে। যাদের সেটা পরিচালনার কথা ছিল, তারা সেখানে ছিল না।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের উপ–মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত বলেন, সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টটি আমরা ইতোপূর্বে পরিদর্শন করে অনেক প্রবলেম পাই। শুরুতে তাদের মৌখিক নির্দেশনা দিই। পরে ডিসেম্বরে আবার পরিদর্শনে যাই। তখন মালিকপক্ষ ৩ মাস সময় চায়। ৩ মাস পর চলতি মাসের মাঝামাঝিতে আবার পরিদর্শনের কথা ছিল। কিছু তারা সংশোধন করেছিল। কিন্তু বাকিও ছিল। তাছাড়া তাদের সীমা অটো রি–রোলিং মিলেও আমরা ফল্ট পাই। শ্রম আদালতে মামলা করি। সেখানে সব পরিপূর্ণ করার আশ্বাস দিয়ে তারা আসে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, বিএম কন্টেনার ডিপোর ঘটনার পর আমরা সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন ডিপো পরিদর্শন করি। দিকনির্দেশনা দিই। অনেকে ব্যবস্থাপনা ভালো করেছে। সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টেও আমরা গিয়েছিলাম ২০২২ সালে। তাদের ফায়ার সেফটি প্ল্যান্ট করতে বলেছি। তারা এখনো বাস্তবায়ন করেনি।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক এস এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ওখানে কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার ছিল। এসব সিলিন্ডারে তারা অক্সিজেন ফিলিং করে। এর কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। অদক্ষ লোক দ্বারা প্ল্যান্ট পরিচালনা করা হয়। সেফটি ভাল্ব বা চেকআপের কাগজ দেখাতে পারেনি।
এ সময় সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের এমডি মামুন উদ্দিন বলেন, মেইনটেইনেন্স কাজে কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার লাগে। আগে নাইট্রোজেন উৎপাদন করতাম। এখন গত ৬ মাস করি না। সিলিন্ডার রয়ে গেছে। দক্ষ শ্রমিকদের বিদায় করে দিয়ে কম বেতনে অদক্ষ শ্রমক দিয়ে কারখানা চালানো হচ্ছিল–এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন মামুন উদ্দিন।
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, আপনাদের বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইসেন্স নেই বলে জানতে পেরেছি। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। বয়লারের অনুমোদন নেই। এমনকি বয়লারে সেফটিও নেই। প্রায় ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন, অনেক কাগজপত্রই নেই।
সভা শেষে এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে সীমা অক্সিকো অক্সিজেন লিমিটেডের এমডি মামুন উদ্দিন দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে সার্কিট হাউস ছেড়ে যান।