পথশিশুদের নিয়ে এক ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম মহানগরী পুলিশ (সিএমপি)। তাদের সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন দুই উপদেষ্টা। পরে তাদের মাঝে উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হয়। সভায় বক্তারা বলেছেন, কষ্টে থাকা পথশিশুদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। আমরা যদি প্রত্যেকেই স্ব স্ব অবস্থান থেকে এদের জন্য কিছু করি তাহলে সমাজে পথশিশু বলে কিছু থাকবে না। তাঁরা বলেন, পথশিশুদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা দেশের স্বার্থেই জরুরি।
গত শুক্রবার মেট্রোপলিটন শ্যুটিং ক্লাবে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক। বিশেষ অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, বিভাগীয় কমিশনার ড. মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীন, ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শামছুল আলম, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। আলোচনা সভার আগে দুই উপদেষ্টা এবং অতিথিবৃন্দ পথশিশুদের সাথে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন। মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজের সভাপতিত্বে ‘একটি নিরাপদ আশ্রয় ও সুন্দর ভবিষ্যৎ সকল শিশুর অধিকার’ প্রতিপাদ্য নিয়ে পথশিশুদের সমাজ ও রাষ্ট্রের মূলধারায় ফেরাতে করণীয় বিষয়ে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
পথশিশু শব্দটি শুনলেই হৃদয়পটে ভেসে ওঠে রাস্তার পাশে বা রেলস্টেশনে অসহায় শিশুগুলোর কথা। দেশে সরকারিভাবে পথশিশুদের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন খণ্ডিত গবেষণা ও জরিপে দেখা যায়, তাদের সংখ্যা প্রায় আড়াই থেকে চার লাখ। আর এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের অধিকাংশ পথশিশুই খাদ্য, বস্ত্র, নিরাপদ বাসস্থানসহ প্রায় সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নিরাপত্তা না থাকার কারণে প্রায়ই শিকার হচ্ছে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের। দুমুঠো ভাতের অভাবে এরা জড়িয়ে যাচ্ছে ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে।
একটি জরিপে দেখা যায়, দরিদ্র শিশুদের ৬৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা, ৫৯ শতাংশ তথ্য লাভের অধিকার, ৪১ শতাংশ বাসস্থান এবং ৩৫ শতাংশ বিশুদ্ধ খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়। যেসব শিশু তাদের পরিবারসহ বা পরিবার ছাড়া বসবাস বা জীবিকা অর্জনের জন্য তাদের বেশিরভাগ সময় রাস্তায় কাটায়, তাদের রাস্তাঘাটে বসবাসকারী শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, এ শিশুদের বেশিরভাগই ছেলে (৮২ শতাংশ) এবং তাদের বেশিরভাগ দারিদ্র্যের কারণে বা কাজের সন্ধানে রাস্তায় আসে। প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ৬ শতাংশ শিশু এতিম অথবা তাদের বাবা–মা বেঁচে আছে কি না তা তাদের জানা নেই। এ শিশুদের প্রতি তিনজনের মধ্যে প্রায় একজন (৩০ শতাংশের বেশি) জীবনের সবচেয়ে মৌলিক সুযোগ–সুবিধা, যেমন ঘুমানোর জন্য বিছানা এবং নিরাপত্তা ও স্বস্তির জন্য দরজা বন্ধ করে রাখা যায় এমন একটি ঘর থেকে বঞ্চিত। তারা পাবলিক বা খোলা জায়গায় থাকে ও ঘুমায়। প্রায় অর্ধেক শিশু মাটিতে ঘুমায় শুধু একটি পাটের ব্যাগ, শক্ত কাগজ, প্লাস্টিকের টুকরো বা একটি পাতলা কম্বল নিয়ে। প্রায় ৭ শতাংশ শিশু সম্পূর্ণ একা ঘুমায় এবং ১৭ শতাংশ শিশু কয়েকজন একসঙ্গে মিলে ঘুমানোর মাধ্যমে সুরক্ষা ও স্বস্তি খোঁজে। শিশুদের প্রতি সহিংসতার প্রতি তিনটি ঘটনার একটি (৩০ দশমিক ৪ শতাংশ) রাতে তাদের ঘুমের সময় ঘটে থাকে। রাস্তায় বসবাসকারী শিশুরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয় পথচারীদের দ্বারা। জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে আটজনই পথচারীদের দ্বারা নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, আজ যে ছোট ছোট শিশুরা রাস্তায় পত্রিকা বিক্রি করে, ফুল বিক্রি করে কিংবা কিছু খাবে বলে টাকা চায় তাদের ভবিষ্যৎ কী? যে বয়সে তাদের হাতে থাকা উচিৎ বই–খাতা সে বয়সে তারা কতটা নির্মমতার শিকার। অনেক শিশু রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছে হাতে প্লাস্টিকের বস্তা। এই পথ শিশুদের দিয়ে আবার অনেকে ব্যবসাও করছে। আমরা রাস্তায় হাটে বাজারে নিজেদের শিশু সন্তান নিয়ে সচরাচর চলাফেরা করলেও ওদের কথা ভাবছি না। ওরাও যে শিশু তা আমরা ভুলে যাই। এককথায় আমাদের মনুষ্যত্ব ও মানবতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলাফলে পথশিশুর সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা যদি একটু সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবি তবে পরিষ্কার হয়ে আসে তাদের জীবনের জটিলতা। নিজেদের জীবন অপেক্ষা অনেকটা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তাদের। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত এরা চুরি, ছিনতাই এবং ভিক্ষাবৃত্তির সাথে জড়িত। আর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ থেকে তারা নানা জিনিস সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য। অনেক শিশু নিজের অজান্তেই ভুগছে নানা রোগে। পথশিশুদের শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ মেয়ে। তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। পড়তে হয় বখাটেদের নজরে। পথশিশুদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে যে মতামত ব্যক্ত হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের স্বার্থেই তাদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা জরুরি।