দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল খালেক হলেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার, যিনি নিজের উজ্জ্বল পেশা ছেড়ে লাইব্রেরি, প্রেস ও পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন এই জনপদের পশ্চাদপদ সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের কর্মজীবন শুরু হওয়ার কথা ছিল শিবপুরেই। তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে সেখানে খুব লোভনীয় বেতনে তার চাকরি হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। মা ও মাতৃভূমির টানে তিনি ফিরে এসেছিলেন দেশেই। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে চাকরি নেন। চাকরি জীবনের প্রথম থেকেই তিনি নিষ্ঠা ও সততার পরিচয় দিতে শুরু করেন। শ্রম ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি কর্মক্ষেত্রকে পবিত্র করে তুলেন। সহযোগী তড়িৎ প্রকৌশলী থেকে তিনি ক’বছরে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হয়ে যান। পরে কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান প্রকৌশলীর পদ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন চাকরি করেননি। মূলত ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকেই তিনি চাকরির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কর্তৃপক্ষ প্রথমে বিশ্বাস করেন নি যে, তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন। তাই আর্থিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিসহ তাকে আরো বড় পদ দিতে চাইলেন। কিন্তু না, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হঠলেন না। তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও পরহিতব্রতে নিজেকে অধিকতর জড়িয়ে রাখার মানসে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। চাকরিতে থাকাবস্থায় ইঞ্জিনিয়ার খালেক ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কোহিনূর লাইব্রেরি এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্পী সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশনায় তিনি যথেষ্ট সহযোগিতা করতেন, অনুপ্রেরণা জাগাতেন। মননশীল সাহিত্য সংকলন প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর কোহিনুর প্রেস ছিল উল্লেখযোগ্য। অন্নদাশংকর রায়, আশুতোষ চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক এদের লেখায় সমৃদ্ধ সাহিত্য সংকলন ‘পূরবী’ ছাপানো হতো কোহিনূর প্রেস থেকেই। বলতে গেলে ইস্টার্ন এক্সামিনার, ইউনিটি ও ইনসাফ –অবাঙালিদের এই তিনটি পত্রিকা ছাড়া চট্টগ্রামের প্রায় সব পত্র পত্রিকাই তাঁর কাছে ঋণী। তাঁর পরিচালিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসি নি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’– কী অসাধারণ সাহস থাকলে বাঙালি বিদ্বেষী পাকিস্তান সরকারের হিংস্রতার সময় একটি প্রেস এমন সাহসী ভূমিকা নিতে পারে।
এমন এক গুণী প্রকৌশলীর প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার একনিষ্ঠ পাঠক আরেক প্রকৌশলী জয়কেতু বড়ুয়া। আজ তাঁর কিছু কথা শোনাবো আমাদের পাঠকদের। প্রকৌশলী জয়কেতু বড়ুয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সংগঠক এবং অব: বিভাগীয় প্রকৌশলী। বয়স নব্বইয়ের কাছাকাছি। আজাদী অন্তঃপ্রাণ মানুষ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আদ্যোপান্ত পড়েন। কোনো সংবাদ বা কোনো লেখা তাঁর ভালো লাগলে ফোন দেন নিয়মিত। কোনো লেখা তাঁর মনোপূত না হলে বা তাঁর অন্তরে আঘাত লাগলেও ফোন দিয়ে তাঁর কষ্টের কথা জানিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে আমি লেখকের মতামতের ভিন্ন মত প্রকাশ বা লেখার স্বাধীনতার কথার কথা তাঁকে বলে সান্ত্বনা দিয়ে থাকি। তিনিও বলেন, ‘আজাদী’ মানে মুক্তি, স্বাধীনতা। পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হলে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তখন মনে হয় যেন নতুনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারছি। আমাদের পরিবারে আজাদীর সঙ্গে পরিচয় অনেক আগে থেকে। সব বিষয়ে আজাদীর জুড়ি মেলা ভার। আজাদী মানে লেখক, পাঠকের মেলবন্ধন।
প্রকৌশলী জয়কেতু বড়ুয়া মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। এমনকি মহান ভাষা আন্দোলনেও ছাত্রাবস্থায় অংশগ্রহণ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানী প্রফেসর ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়ার এক লেখায় পাই, “মীরসরাই সরকারহাট নজরানী রূপমন হাইস্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় জয়কেতু বড়ুয়া ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই’ স্লোগান নিয়ে সতীর্থদের সাথে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। ঢাকা–চট্টগ্রাম রেললাইন অবরোধ এমনকি নিজামপুর হাইস্কুলে সমাবেশ সত্যি সত্যি তাঁর তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, প্রতিবাদ ও ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্পৃক্ততা নিবিষ্টভাবে প্রমাণিত। সেদিন তাঁর সহযোগী ছিলেন আবু জাফর, রবিউল হোসেন, এডভোকেট সনজীব বড়ুয়া, হেডমাস্টার রবিউল হোসেন ও মফিজউদ্দীন ও ড. শহীদুল্লাহ অন্যতম।” প্রফেসর ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া আরো লিখেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের (অব.) বিভাগীয় প্রকৌশলী জয়কেতু বড়ুয়া জাতীয় পত্রিকা দৈনিক আজাদী, জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন পত্রিকার নিয়মিত লেখক। তিনি প্রায় তিনদশক ধরে মন, মানুষ, মাটি ও স্বদেশের কথা নিঃসঙ্কোচে লিখেছেন। উপলক্ষ্য : মানবতা, মনুষ্যত্ব, অন্ধকার বিনাশী আলোর উজ্জ্বলতায় এক আধুনিক বিজ্ঞান মনষ্ক যুবমানস প্রতিষ্ঠা করা। জীবন–জীবিকা, মানব প্রেম, প্রকৃতি প্রেম ও পরিবার, মুক্তিযুদ্ধ এবং সাম্যের বাণী সতত প্রচারে স্বীয় সদ্ধর্মের কিছু যুক্তি–যুক্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সুপ্রাচীন তথ্য ও সংশ্লিষ্ট কাহিনী তাঁর লেখার উপজীব্য। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী সদা হাস্যময় প্রকৌশলী জয়কেতু বড়ুয়ার লেখা সুন্দর; ভাবভাষা সহজবোধ্য, সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত ও বর্ণনায় আড়ম্বর বিবর্জিত। স্বদেশপ্রেম, সংগত তথ্য ও শোভনীয় উপস্থাপনায় তিনি সর্বমহলে নন্দিত।
প্রকৌশলী জয়কেতু বড়ুয়া ইতোমধ্যে ‘মুক্তিযুদ্ধে আমি’সহ বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করেছেন। মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য বিষয়ে আলোকপাত হয়েছে বইগুলোতে। তিনি এক লেখায় লিখেছেন, “ভাষা মানুষের আত্মপ্রকাশের পবিত্র অবলম্বন। জন্মের পর থেকে আমরা যে ভাষায় কথা বলি সেটাই মাতৃভাষা। পৃথিবীর কম জাতির মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষায় পরিণত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ৫৪% হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ ১৯৪৮ সালে ‘ল’ পড়ার সময় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের অংশ নেন এবং জেল থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার আন্দোলনে বাংলার ছাত্র শিক্ষক সহ সমস্ত দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেন। এর একই ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, রফিক, জব্বর, বরকত, শফিউল্লাহ সহ প্রমুখ ছাত্রজনতা বুকের রক্ত দিয়ে এই আন্দোলন জোরদার করেন এবং যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা স্বীকৃত হয়। এই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয় এবং ৩০ লক্ষ্যের প্রাণের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।”
পত্র–পত্রিকা ও বই তাঁর অবসরের নিত্যসঙ্গী। তিনি মনে করেন, বই মানুষের জ্ঞানলাভের ভাণ্ডার। পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় জ্ঞান লাভের প্রকৃত উপায় বই পড়া। একমাত্র বই পড়লে মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা কষ্ট দূর হয় এবং বই পড়ার অভ্যাস এই সমাজে তথা দেশে পরিবারের মানুষ যেকোনো দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করে এগিয়ে যেতে পারে। বইমেলার প্রতি তাঁর টান অগাধ। বলেন, আমাদের ভালোবাসা, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, উন্মাদনার উৎস হল বই মেলার আয়োজন।
জানা যায়, মানবতাবাদী সমাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এই লেখক প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যে তাঁর দেহ ও চক্ষু মরণোত্তর উৎসর্গ ও দান করেছেন। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা সম্পন্ন করে রেখেছেন। ইতোপূর্বে তাঁর প্রয়াত স্ত্রী অর্পিতা বড়ুয়া টুলু ২০০৮ সালে পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দান করে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে অধিষ্ঠিত আছেন তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের অধিকারী লেখক–পাঠক। পত্র–পত্রিকা ও বই যাঁদের অবসরের নিত্যসঙ্গী, তাঁদের মতো মানুষের সংখ্যা সমাজে বৃদ্ধি পাক, সেই প্রত্যাশা আমার।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।