উপমহাদেশের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় পণ্ডিত বিহারের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে খনন কাজ শুরু করতে যাচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠানের দেয়াঙ পাহাড়ের ঐতিহাসিক বিশ্বমড়া এলাকায় প্রাচীন পণ্ডিত বিহারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করার লক্ষ্যে খনন কাজ উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে।
ঐতিহাসিকদের ধারণা, কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ও জুলধা এলাকা জুড়ে খিস্ট্রীয় অষ্টম শতাব্দীতে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। এটি মূলত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তৎকালীন সময়ে যা পূর্ববঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে শিক্ষা ও মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হতো। গবেষকদের অনুমান, বিভিন্ন বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ এই বিহারে সমবেত হয়েছিলেন বলে সম্ভবত পণ্ডিত বিহার নামকরণ হয়েছিল। পাল সাম্রাজ্যের বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পণ্ডিত বিহারে অবস্থান ও অধ্যয়ন করেছিলেন। অধ্যাপকেরা অধ্যাপনা, অধ্যয়ন ও যোগ সাধনার পাশাপাশি অবসরে যেসব গান–দোঁহা রচনা করেছিলেন, তা পরবর্তীকালে চর্যাপদ নামে বাংলা ভাষা ও কাব্যের আদি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তবে পণ্ডিত বিহারের বিলুপ্তি হবার কারণ সম্পর্কে জানা যায় না। ধারণা করা হয়, আরাকানদের সাথে মোগলদের বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহে চট্টগ্রামের প্রাচীন বন্দর শহর দেয়াঙ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এরই ফলস্বরূপ এবং কালের বিবর্তনে পণ্ডিত বিহারের বিলুপ্তি ঘটে।
জানা যায়, ষোড়শ শতকের দিকে বিলুপ্ত হওয়া ঐতিহাসিক পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বিশেষ প্রতিনিধি দল সরেজমিন আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড় অঞ্চলে পণ্ডিতবিহারের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করেছেন। চীন, জাপান, থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকার যৌথ অর্থায়নে প্রায় দেড়শ একর পাহাড়ি ভূমিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই জ্ঞান চর্চা কেন্দ্রকে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক টিম ঐতিহাসিক ওই স্থান একাধিকবার সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনকালে প্রত্নতাত্তিক অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ভাষা বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু, নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল মাত্রা, ইতিহাসবিদ জামাল উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি মাদল চন্দ্র বডুয়াসহ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রত্নতাত্তিক খনন কাজের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে মতবিনিময় সভা করেছে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের প্রতিনিধিরা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ। সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করার বিষয়ে সহযোগিতা করার বিষয়ে মত দেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন কর্ণফুলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পীযূষ কুমার চৌধুরী, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের উপপরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান, ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. শাহীন আলম, প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের গবেষণা সহকারী মো. নিয়াজ মাগদুম ও সার্ভেয়ার চাই থোয়াই মারমা।
ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের পর ওই জায়গায় জাদুঘর স্থাপন হবে বলে জানিয়েছেন জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের উপপরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান।