পঞ্চান্ন বছরে ইলিশের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে ২ হাজার গুণ

মুস্তফা নঈম | সোমবার , ২৫ আগস্ট, ২০২৫ at ৫:০৯ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের ৮৬ শতাংশই হয় বাংলাদেশে। অথচ সেই ইলিশের স্বাদ দেশের মধ্যবিত্তরাও নিতে পারছে না। বাজারে ইলিশের ক্রমবর্ধমান মূল্য বাড়ার কারণে নিন্ম মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তদের পাতেও উঠছে না ‘জাতীয় মাছ’ ইলিশ। একটা সময় ইলিশকে বলা হতো গরিবের মাছ। গল্পটা ষাটের দশকের শেষ দিকের। হিসাবটা ১৯৬৯৭০ সময়ের, সে সময় প্রতি সের (তখন কেজি প্রথা ছিলো না) ইলিশ মাছের দাম ছিলো মাত্র ৭৫ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১টাকা ৭৫ পয়সা। পঞ্চান্ন বছরে ইলিশের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে ২ হাজার গুণের বেশি।

ইলিশ উৎপাদনে ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। ওয়ার্ল্ড ফিশের পরিসংখ্যান মতে, ৮৬ শতাংশ ইলিশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়, কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।

বর্তমান মৌসুমেও আকারভেদে প্রতি কেজি ইলিশ চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫শ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। যদি ষাট দশকের শেষ সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইলিশের গড় মূল্যবৃদ্ধি হিসাব করা হয় তাহলে আমরা দেখি গত ৫৫ বছরে ইলিশের দাম বেড়েছে প্রায় ১৫ শত থেকে ২ হাজার গুণ।

ওইসময় গ্রামের হাটেবাজারে রুইকাতল কিংবা কোরাল এবং লাক্ষা মাছ প্রতি সের (কেজি প্রথা চালু ছিলো না) বিক্রি হতো আড়াই থেকে তিন টাকায়। আর ওই সময় প্রতি সের ইলিশ মাছের দাম ছিলো মাত্র ৭৫ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১টাকা ৭৫ পয়সা। ইলিশ মাছে নানান ধরণের এলার্জির অনুসঙ্গ রয়েছে অজুহাতে ধনী বা বড় লোকদের কাছে তেমন কদর ছিলো না ইলিশের। খুবই কম পৌঁছাতো তাঁদের রসুই ঘরে। ইলিশ যেহেতু বর্ষার মাছ। গ্রামের হাটেবাজারে প্রচুর ইলিশ দেখা মিলতো। তখনকার সময় গ্রামের হাটে মাছ সংরক্ষণের আধুনিক কোন ব্যবস্থা ছিলো না। বিক্রেতারা কমবেশি দরে মাছ বিক্রি করেই বাড়ি ফিরতেন। একসময় চট্টগ্রামের হাটে বাজারে যা ইলিশ বিক্রি হতো সব ‘চাঁদপুইজ্জা (চাঁদপুর) ইলিশ’ নামে। ইলিশের এই গল্পটা ১৯৬৯৭০ সময়ের। তখন আমাদের প্রাথমিক স্কুলের শেষ বেলা। সেই সময় আমাদের বাসস্থানের অদূরে একটি হাট ছিলো। প্রতিসপ্তাহে সেই হাট থেকে সদাইপাতি কিনতে হতো অবশ্যই এক বড় ভাইয়ের সাথে। যারা গ্রামে বেড়ে উঠেছেন এবং হাটে যাওয়ার অভ্যাস ছিলো হাট থেকে সদাইপাতি ক্রয় করতেন আমার সাথে হয়তো তাঁদের অভিজ্ঞতা মিলেই যেতে পারে। ইলিশের মৌসুমে আমরা দেখেছি গ্রামের অতি সাধারণ মানুষ প্রায় প্রতি হাটেই অন্যান্য সদাইপাতির সাথে একটা ইলিশ কিনে বাড়ি ফিরতে। বিক্রেতারা ইলিশের কানের ভিতর সুতা বেঁধে ঝুলিয়ে দিত ক্রেতার হাতে।

এমনও ঘটনা আছে নিম্নবিত্ত হোক আর নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারে কোন অতিথি আসলে উনাদের পাতে ইলিশ দিতে লজ্জা বোধ করতেন ঘরের গৃহিনীরা। তাঁরা ইলিশের বিকল্প দিয়ে অতিথি অপ্যায়ন করতেন। কারণ হচ্ছে ইলিশ গরিবের মাছ। বর্তমান সমাজ বা সময় ইলিশের সেই বলয় থেকে ছিটকে পড়েছে।

সময়ের আবর্তে দেশে কেন ইলিশ মাছ হয়ে উঠলো আভিজাত্যের প্রতীক। কেন গরিবের ইলিশ চলে গেলো নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তের নাগালের বাহিরে। চট্টগ্রামের প্রবীণ কয়েকজন ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে, ৮০’র দশকের শেষের দিকে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অনুসঙ্গে হঠাৎ যুক্ত হলো পান্তাইলিশ খাবার এক নতুন সংস্কৃতি। ইলিশ হচ্ছে বর্ষার মাছ। বর্তমানে বৈশাখে গড় মূল্য বেশি পেতে এক ধরণের ব্যবসায়ীরা কোল্ড স্টোরেজ এ ইলিশ মজুদ করে রাখে।দেশের অভিজাত হোটেলমোটলে রাখা হয় পান্তাইলিশের আয়োজন। এমনও দেখা গেছে চট্টগ্রামের অভিজাত হোটেল গুলোতে বৈশাখের প্রথম দিনে এক পিস ইলিশ বিক্রি হয় এক হাজার টাকায় ! আবার প্রবাসে থাকা বাঙালিদের জন্যও প্রচুর পরিমাণ ইলিশ রপ্তানী করা হয় বিদেশে।

বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের ৮৬ শতাংশই হয় বাংলাদেশে। অথচ ভরা মৌসুমেও আকারভেদে প্রতি কেজি ইলিশ চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫শ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত।

দেশের মৎস্য সম্পদ সংশ্লিষ্ট সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ ও প্রান্তিক পর্যায়ে মৎস্য আহরণ ও বিপননে যুক্ত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ইলিশ আহরণ হ্রাস, মজুদ, কারসাজি, অবৈধ পথে পাচার ও আহরণের ব্যয়বৃদ্ধিসহ ইলিশ মাছের লাগামহীন দামবৃদ্ধির কারণ ।দাদন দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের সিন্ডিকেটের কারণেই ইলিশের দাম এত বেশি হতে পারে। ইলিশ নিয়ে বাজারে সরকার নজরদারি থাকলে দাম কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো বলে তিনি উল্লেখ করেন।

চট্টগ্রামের বাজার : নগরির চকবাজারে দীর্ঘ ২৫ বছর মাছ বিক্রি করেন নবী সওদাগর। আর ১৫ বছর ধরে বিক্রি করেন শামসুল আলম। এই দুই মাছ বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা ২০১১ সালে ৯শ থেকে ১০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি করতেন ৬শ থেকে ৭শ টাকা। ২০২৫ সালে এসে একই ওজনের ইলিশ তারা বিক্রি করছেন ১৯শ থেকে ২১শ টাকা। দুই কেজির কাছাকাছি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায়। আবার দেশে ভোক্তাদের নিয়ে কাজ করা কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে ১০০০ গ্রাম ইলিশের বার্ষিক গড় মূল্য ছিলো ২৪৯.০৮ টাকা আর ২০২১ সালে একই পরিমাণ ওজনের ইলিশের গড়মূল্য দাঁড়ায় ১২২৭. ৬৭ টাকা।

সাম্প্রতিক সময়ে সাগরে ইলিশ আহরণের হার ক্রমবর্ধমান হ্রাসের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাঈদুর রহমান, ‘সাগর ও নদীতে ওভার ফিশিংএর একটা প্রভাবের কথা বলেছেন । সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এ অধ্যাপকের মতে, সাগরে মাছ আহরণকারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারগুলো অত্যাধুনিক সোনার প্যানেল এর মাধ্যমে সামুদ্রিক মাছের ঝাঁকের অবস্থান নির্ণয় করে তারা বেসুমারভাবে ইলিশ আহরণ করে। এসব সোনার প্যানেল খুলে নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো। যা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, সাগর ও নদী থেকে ১০ শাতাংশের বেশি ইলিশ আহরন করা যাবে না। বঙ্গোপসাগরে মাছের মজুদ বৃদ্ধির জন্য এনর্ফোজমেন্ট কার্যক্রম বাড়াতে হবে।’

প্রজননে বাধা: জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি ইলিশ বিচরণ ক্ষেত্র নদী গুলোর তীরে অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে উঠায় নদীর পানির মারাত্মক দূষণ হচ্ছে। এসব কারখানার বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে দূষণের কারণে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন সরকারের সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ ব্যবস্থাপনা ইউনিট এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা। তাঁদের মতে, প্রজনন ক্ষেত্র নিরাপদ থাকলে নদী ও সাগরে মাছ বৃদ্ধি পাবে। আবার সাগরে ইলিশ শিকারে যাওয়া জেলেরা বলছেন, চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর হয়ে লক্ষ্মীপুর ভোলা এলাকায় নদীর মোহনায় সাগরে ডুবোচরের কারণে আগের মতো ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।

লেখক : সাংবাদিক ও গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেখ-ই-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার : একটি আবেদন
পরবর্তী নিবন্ধসুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি আহমদ ছফার ভালোবাসা