দেশের স্মরণকালের ইতিহাসে সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদন হলেও চাষীরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। লবণের ‘বাড়তি উৎপাদন চাষীদের সর্বনাশ’ ঘটাচ্ছে উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, স্বাভাবিক বাজার দরের অর্ধেক দামেই লবণ বিক্রি হচ্ছে। উপরন্তু গতবারের মতো এবারও বিদেশ থেকে লবণ আমদানির চেষ্টা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের লবণ শিল্প এবং এর সাথে জড়িত চাষীদের বাঁচাতে সরকারের জরুরি পদক্ষেপ নেয়া দরকার। গতকাল কক্সবাজারের লবণ মোকামগুলোতে প্রতি মণ লবণ ২১০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। যা স্বাভাবিক সময়ে ৪ শ’ টাকার বেশি বিক্রি হয়ে থাকে।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের লবণ শিল্প দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বহু বছর ধরে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় লবণ চাষের প্রচলন দীর্ঘদিনের। গত অর্থবছরে দেশে ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর জমিতে লবণ চাষ হয়। যা আগের বছরের তুলনায় ১ হাজার ৯৩৩ একর বেশি। গত মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয়েছে ২২ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন, যা দেশের স্মরণকালের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। চলতি মৌসুমে দেশে ২৬ লাখ টন লবণ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার টন। দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টনের কাছাকাছি। এরমধ্যে গৃহস্থালি তথা ভোজ্য লবণের বার্ষিক চাহিদা দশ লাখ টনের মতো। শিল্প কারখানায় লবণের বার্ষিক চাহিদাও ১০ লাখ টনের কাছাকাছি। চামড়া প্রক্রিয়াকরণ, টেক্সটাইল, কাগজ, সাবান, ডিটারজেন্ট, রাসায়নিক এবং অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে লবণ ব্যবহৃত হয়। শিল্প খাতের সমপ্রসারণের সাথে সাথে দেশে লবণের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের চাহিদার তুলনায় বেশি লবণ উৎপাদিত হলেও বিভিন্ন সময় সরকার বিদেশ থেকে লবণ আমদানির অনুমোদন দেয়। গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২৬৪টি প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমোদন দেয়। যা সরাসরি দেশের লবণ চাষীদের আঘাত করে বলেও গতকাল একাধিক চাষী জানিয়েছেন।
সূত্র বলেছে, বাংলাদেশে মূলত সৌর পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন করা হয়। সাগরের পানি মাঠে আটকে রেখে রোদে শুকিয়ে বের করা হয় লবণ। ২০০০–২০০১ সাল থেকে পলিথিন পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন শুরু হয়। যা সনাতন পদ্ধতির তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি উৎপাদন সক্ষমতা প্রদান করে। একইসাথে এই পদ্ধতিতে লবণের মানও ভালো থাকে। লবণের মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই মাঠ থেকে তোলা হচ্ছে হাজার হাজার টন লবণ। কিন্তু এই লবণ বিক্রি করতে গিয়ে চাষীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে। প্রতিমণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকা দরে। এতে শ্রমিকের চড়া মজুরি, জমি ইজারা খরচসহ বিভিন্ন খাতের খরচ তুলতেই চাষীরা হিমশিম খাচ্ছেন।
গতকাল মহেশখালীর মোহাম্মদ একরাম নামের একজন লবণ চাষী আক্ষেপ করে জানান, প্রতিমণ লবণ ২০০ টাকায় বিক্রি করে খরচই উঠছে না। অপর একজন চাষী বলেন, উৎপাদন ভালো হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় লবণের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু এই বাড়তি উৎপাদন আমাদের সর্বনাশ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
চাহিদার তুলনায় বহু বেশি লবণ উৎপাদন হলেও তা সংরক্ষণের অবকাঠামো প্রান্তিক পর্যায়ে নেই। চাষীদের লবণ বিক্রি করে খরচ মেটাতে হচ্ছে বলেও তারা জানান।
লবণের এই বাড়তি উৎপাদনের মাঝেও শিল্পে ব্যবহারের নামে লবণ আমদানির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে লবণ ব্যবসায়ীরা জানান, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি হলে দেশের লবণের দাম আরো কমে যাবে। চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সামনের দিনগুলোতে কেউ আর লবণ চাষে আগ্রহী হবেন না বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। প্রতি কেজি লবণ চাষীরা ৫ টাকা দরে বিক্রি করলেও ভোক্তাপর্যায়ে প্যাকেটজাত লবণের দাম ৪০ থেকে ৪৫ টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, দেশের লবণ শিল্প সামপ্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি চাষের জমি ও চাষীর সংখ্যাও বেড়েছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে আমদানির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। লবণ শিল্পের স্থিতিশীলতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি বলেও তারা মন্তব্য করেন।