নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। ইতিমধ্যে জামানতবিহীন ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক ব্যবসা এবং থ্রি জিরো তত্ত্বের জন্য বিশ্বব্যাপী তিনি নন্দিত হয়েছেন। উৎপাদন, কর্মসংস্থান, শিল্প কারখানা পরিচালনা এবং ব্যবসা পরিচালনায় পুঁজি অপরিহার্য। দারিদ্র বিমোচনে পুঁজি কোন অনুদান নয়, অধিকার। সামাজিক ব্যবসা ও সেবা পরিচালনার মাধ্যমে সমাজে অনেক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। শূন্য দারিদ্রতা, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য কার্বন নির্গমন ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্বের মূল কথা। অর্থশাস্ত্রে নতুন নতুন তত্ত্বের আবিষ্কার ও প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তিনি চমক সৃষ্টি করেছেন।
অর্থনীতির পুঁথিগত বিদ্যা পৃথিবীকে ভুল পথে পরিচালিত করে যাচ্ছে। এ পৃথিবী অর্থনীতির অনাসৃষ্টি বৈ তো অন্য কিছু নয়, শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করেই এ শাস্ত্র ক্ষান্ত হয়নি। আগামীতে পরিকল্পনা অনুযায়ী কী করা উচিত, কী করা অনুচিত সে ব্যাপারেও মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে।
অর্থশাস্ত্র মগজ ধোলাই করে মানুষের অভ্যন্তরে এমন এক বিচিত্র মননশীলতা সৃজন করে; পরবর্তীতে সেই মননশীলতার সৃষ্ট কর্মকাণ্ড আজকের পৃথিবীকে পরিচালিত করে যাচ্ছে। অর্থশাস্ত্রের তত্ত্ব অনুসারে দারিদ্র্য বিমোচনের সর্বোত্তম পথ হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। এ বিষয়ে বিশ্বের সকল অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং সমস্ত বিশেষজ্ঞরা একমত কিন্তু অর্থশাস্ত্র যে কর্মসংস্থানের স্বীকৃতি দেয় তা হলো, মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থান (Wage for Employment)। অর্থনীতিতে আত্মকর্মসংস্থানের অস্তিত্ব নেই। অর্থনীতিবিদরা এমন এক অর্থ পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন যেখানে আমরা শিশু–কিশোরকালে নিজেকে প্রস্তুতির কাজে অতিক্রম করি যেন যৌবনে পদার্পণের সাথে সাথে নিয়োগকর্তার চোখে এক আকর্ষণীয় কঠোর পরিশ্রমী এবং অনুগত দাস হিসাবে বিবেচিত হতে পারি। যখন আমাদের প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয় তখন শ্রম বাজারে নিজেকে উপস্থাপন করে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হই। যদি কেউ নিয়োগকর্তা পেতে ব্যর্থ হই কিংবা শ্রম বিনিময়ে ব্যর্থ হই তখন বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশের অধিবাসী হিসাবে জীবনে নেমে আসে বেকারত্বের গ্লানি, দুঃখ, প্রবঞ্চনা এবং দারিদ্র্য। বিষয়টি ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করেন গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি মনে করেন, একজন নিয়োগকর্তার কাছে নিজেকে উপযোগী করার বিষয়টি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। মানুষের মহামূল্যবান জীবন ও সময় অপচয় করতে হচ্ছে শুধুমাত্র একজন নিয়োগ কর্তার সন্ধানে। সে নিয়োগকর্তার কাছে অর্থের বিনিময়ে নিজের শ্রম ও সত্তা দাসত্বের শৃঙ্খলে বিলীন করে দিতে হয়। যখন পৃথিবী নামক এই গ্রহে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন তারা চাকুরির আশায়, নিয়োগকর্তার প্রত্যাশায় নিজেকে কখনো প্রস্তুত করতেন না। তারা তাদের নিজেদের কাজ নিজেরা সৃজন করতেন। তারা শিকার করতেন, পশু পালন করতেন, চাষাবাদ করতেন, বুনন কাজে নিয়োজিত থাকতেন।তারা স্বয়ম্ভর মানুষ ছিলেন। পুঁথিগত বিদ্যায় আত্মকর্মসংস্থানের কোন গুরুত্ব নেই। যার কারণে বাস্তব জীবন আজ দুর্দশাগ্রস্ত। যেহেতু অর্থশাস্ত্রে বিষয়টি নিরুদ্দিষ্ট ফলে নীতিমালা প্রণয়নকারীদের মস্তিষ্কে এর অস্তিত্ব নেই। বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য আত্মকর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচনে নতুন প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থার কর্মকাণ্ড প্রশ্নাতীতভাবে অপরিহার্য।
অর্থশাস্ত্রের অভিজাত তত্ত্ব যুগ যুগ ধরে আমাদের অর্থ ব্যবস্থার অবকাঠামো তুলেছে। কিন্তু সেই তত্ত্বে দারিদ্রকে পরিত্যক্ত করা হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের প্রসঙ্গে অর্থশাস্ত্র তা এড়িয়ে গিয়ে মূল্যবান তত্ত্বের কথা বলে। অর্থশাস্ত্রের ভিত্তি “অর্থনৈতিক মানুষ”। রবিনসন ক্রুশোর গল্পের মতো সেই অর্থনৈতিক মানুষের তো কোন শৈশব নেই, বার্ধক্য নেই, নেই কারো ওপর নির্ভরশীলতা। নিজের কাজে ছাড়া অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই ।
অর্থনৈতিক মানুষের প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিল নিজেই অর্থনৈতিক মানুষের সমালোচনা করেছেন। অর্থনৈতিক মানুষ অর্থলোভী, ভবিষ্যতের চেয়ে বর্তমান পছন্দ করেন। তাই ভোগ বিলাসিতা চায়। সম্পদের উৎসের অনুসন্ধান এবং সম্পদের সদ্ব্যবহার নিয়ে অর্থনীতিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু অর্থশাস্ত্রে কখনো কোন দিন পারিবারিক অসচ্ছলতার বিশ্লেষণ এবং দারিদ্র্যের কারণ অনুসন্ধান করা হয় না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজকীয় ব্রিটিশের স্বাধীন উপনিবেশ সমূহে “উন্নয়ন অর্থনীতির” আওতায় দারিদ্র্য বিমোচনে যে গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল সেই উন্নয়ন মূলত পুঁথিগত অর্থশাস্ত্রের মূল তত্ত্বের প্রতিচ্ছবি, ফলে দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ কোন অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। তত্ত্বীয় অর্থশাস্ত্রের আরো এক ক্ষতিকর ক্ষেত্র “ঋণদান পদ্ধতি”।এ ক্ষেত্রে অর্থশাস্ত্র সমাজ বিজ্ঞান হিসাবে অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে। অবাক কাণ্ড! “ঋণ” যে একটি সামাজিক শক্তি, অর্থশাস্ত্র তা গুরুত্ব সহকারে উপলব্ধি করতে চায় না। ব্যবসা–বাণিজ্য ও শিল্পের চালিকা শক্তি হিসাবে ঋণকে অর্থশাস্ত্রে বিবেচনা করা হয় বটে কিন্তু ঋণের মাধ্যমে মানুষ সম্পদের ওপর স্বত্বাধিকার অর্জনে সক্ষম অর্থশাস্ত্র বিষয়টি বিবেচনা করার অবকাশ পায় না। ঋণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক শক্তি, সামাজিক শক্তি ও ক্ষমতায়ন অর্জিত হয়। কে কতো টাকা ঋণ পাবেন, কে পাবেন না, কে কী শর্তে ঋণ পাবেন– তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই প্রতিষ্ঠান মানুষের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে।
ঋণ প্রদানকারী সংস্থা এবং ব্যাংক প্রণীত নীতিমালার আলোকে একটি বিশেষ শ্রেণি সব সময় ঋণ প্রাপ্যতার যোগ্যতা অর্জন করে। যে ধনাঢ্য শ্রেণি ব্যাংক নীতিমালার প্রতিবন্ধকতা উত্তরণ করে ঋণ পায় তারা সমাজে প্রবল ক্ষমতাশীল এবং অর্থনেতিক মর্যাদা লাভ করে। যারা ঋণ প্রাপ্তিতে অক্ষম হয় তারা দুঃখ–দুর্দশা এবং দারিদ্র্যের কাষাঘাতে জর্জরিত হয়। যারা বিত্তবান, ক্ষমতাশীল এবং ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা জামানত প্রদানের ক্ষমতা রাখেন ব্যাংক শুধু তাদের ঋণ দেয় কিন্তু সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত, সহায় সম্বলহীন দরিদ্র মানুষ যারা ব্যাংকের দুয়ারে পৌঁছতে সক্ষম হয় না, যাদের অর্থ–বিত্ত এবং জামানত প্রদানের মতো পর্যাপ্ত সহায় সম্পদ নেই প্রচলিত ব্যাংকের চোখে তারা ঋণ পাওয়ার অযোগ্য। অথচ সেই উদ্যোক্তা যিনি নিজের কঠোর পরিশ্রম এবং স্ব–উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও নৈপুণ্যতায় উৎপাদনে অংশগ্রহণে সক্ষম অথচ শুধু ক্ষুদ্র পুঁজির অভাবে বেকার জীবন যাপন করছেন তাকে ঋণ প্রদানের অক্ষমতা প্রদর্শন করে অর্থশাস্ত্র মাটি ও মানুষের সাথে প্রতারণা করে থাকে। ব্যাংক কর্তৃক ঋণ প্রাপ্যতার এ অযোগ্যতা, এ অক্ষমতার ঘোষণা দরিদ্র উদ্যোক্তার জন্য মৃত্যু পরোয়ানার সামিল। প্রফেসর ইউনূস আরো মনে করেন, সকল মানুষের মধ্যে উদ্যম, মেধা, নৈপুণ্যতা ও সৃজনশীলতা রয়েছে। এক একজন মানুষ এক একটা আবিষ্কারের বিস্ময়কর খনি, অথচ সম্ভাবনাময় এ সম্পদ সমাধিস্থ করে ভুল মতবাদ ও ভুলে ভরা অহমিকার ওপর ভর করে মানুষকে নিক্তির পাল্লায় ওজন দিয়ে মানুষের মধ্যে শ্রেণি বৈষম্য সৃষ্টি করে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। মানুষ যা করতে সক্ষম তার বিপরীতে ততোধিক অক্ষম হিসাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। পুঁথিগত অর্থশাস্ত্র আমাদেরকে মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের (Wage for Employment) সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। মজুরির বিনিময়ে নিয়োজিত থাকে যে মানুষ অর্থনীতিতে তার নাম রাখা হয়েছে শ্রমিক। সেই শ্রমিক নামক মানুষগুলো যেন গভীর অরণ্যে শিকারীর রূপালি জালে আটকে পড়া বাঘের বাচ্চা। এদের সৃজনশীলতা, শক্তি, সাহস, বুদ্ধিমত্তা এবং জীবিকার অবলম্বন শিকারীর মায়াজালে অবরুদ্ধ। যদি মানবতা বাদ দিয়ে মানুষের বিস্ময়কর সম্ভাবনা, সৃজনশীলতা ও আত্মকর্মসংস্থান মাথায় না রেখে অর্থনীতির বড় বড় তত্ত্ব ও সমাজ বিজ্ঞান বিনির্মাণ করা হয়, তা মানব কল্যাণে আসবে কী? এতে পরিবার, নারীর অবদান, গৃহস্থালী এবং আত্মকর্মসংস্থানের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থনীতির যাঁতাকলে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যায়। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেঁচে রয়েছে। অর্থনীতির তত্ত্বীয় অবকাঠামোতে আত্মকর্মসংস্থানের (Self Employment) মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে গিয়ে আত্মকর্মসংস্থানকে প্রথা বহির্ভূত খাত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মানুষের আবিষ্কার, উদ্যম প্রতিভা ও নৈপুণ্যতা বিকাশের স্বার্থে, মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের স্বার্থে প্রত্যেকে ঋণ পাওয়ার অধিকারী। যদি অর্থশাস্ত্রকে সংস্কার করে পুঁথিগত তত্ত্বের বাইরে এনে বাস্তবমুখী করা যায় তবে দারিদ্র্যমুক্ত নতুন পৃথিবী গড়া সম্ভব। এ হলো অর্থশাস্ত্রের নিরুদ্দিষ্ট প্রবাহ, যার কারণে পৃথিবীতে শ্রেণী বৈষম্য এবং দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে আবার অন্যভাবে ঘুরিয়ে বলতে হয় এ হলো দারিদ্র্য বিমোচনে ইউনোসনমিকস্ তত্ত্ব (Theory of Yunusonomics), তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য বিমোচনের দর্শন। প্যারিস থেকে ঢাকা বিমান বন্দরে তিনি বলেন বাংলাদেশ সুন্দর সম্ভাবনাময় একটি দেশ। আমাদের সম্ভাবনাগুলোকে আমরা নষ্ট করে দিয়েছি এখন আবার সেই বীজ তলা তৈরি করতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম এই বীজ তলা তৈরি করবে হাত দিয়ে। তাদের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি। ড.মুহাম্মদ ইউনুস বলেন আমরা একটা পরিবার যেন আমাদের মধ্যে যেন গোলযোগ না হয়। আমরা যেন একযোগে এক সাথে চলতে পারি আমরা ত্বরিৎ গতিতে একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে পারি সেটাই আমাদের কামনা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, চা শিল্প নির্বাহী, গবেষক