পৃথিবী জুড়েই নারী তার নিজের তৈরি কাঠামোতে বেড়ে ওঠে না, বেড়ে উঠতে হয় প্রতিবন্ধকতাময় পুরুষের তৈরি করা কাঠামোতে। সুতরাং পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে একজন নারীর সফলতা, বড় কিছু অর্জন, নারীর জন্য নিঃসন্দেহে সুখবর ও অনুপ্রেরণামূলক।
এবছর সাহিত্যে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার, নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন কোরিয়ান লেখক হান কাং। আরও একটু বেশি উচ্ছ্বসিত আমরা হতেই পারি বাড়ির কাছের মানুষ অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার নারী লেখক বলে।
হান কাং–কে নিয়ে এ–পর্যন্ত ১৮জন নারী সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন।
৫৩ বছর বয়সী হান কাং লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন প্রথমত কবিতা দিয়ে। ১৯৯৫ সালে তাঁর ছোট গল্পের একটা সংকলন বের হয়। সেটার মাধ্যমে তিনি পাঠকনন্দিত হন। ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য বই। এই বই প্রকাশের এক দশক পর বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডেবোরাহ স্মিথ। পরের বছরই এই উপন্যাস ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। তাঁর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে দ্য হোয়াইট বুক, হিউম্যান অ্যাক্টস, গ্রিক লেমনস, ইওর কোল্ড হ্যান্ডস ও স্কারস। সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সেক্রেটারি ম্যাটস মালম ও হান কাং–এর একটা অডিও রেকর্ড শুনলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেটি ছিল হান কাং–কে নোবেল পাওয়ার সংবাদ দেওয়ার জন্য মালম করেছিলেন। কি নির্লিপ্ত কণ্ঠে কথা বলছেন হান! যদিও তিনি বলেছেন তিনি চমৎকৃত এবং সম্মানিত বোধ করছেন। ম্যাটস মালম বলেন, চমকে দিতে আমি হানকে বেশ কিছুক্ষণ ফোনে আটকে রেখেছিলাম। মনে হয়েছে তিনি এই খবরের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি অন্যান্য দিনের মতো একটি সাধারণ দিন কাটাচ্ছিলেন। এবং সবেমাত্র তাঁর ছেলের সাথে ডিনার করছিলেন।
এই বছর নোবেল পাওয়ার সম্ভাব্য সর্বাধিক উচ্চারিত নামগুলোর মধ্যে হান কাং এর নাম ছিল না। নোবেল কমিটি বলছেন, তিনি এমন একজন, যিনি সংগীত ও শিল্পকলার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। মানুষের জীবনের নানাদিক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাই তাঁর কাজকে কোনো সীমানায় ফেলা যায় না। সহিংসতা, দুঃখকষ্ট ও পুরুষতন্ত্রের নানা বিষয় উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। মানব জীবনের অন্তর্গত দুঃখ কষ্টের কাব্যিক রূপায়নের স্বীকৃতি হিসেবে হান কাং–কে নোবেল পুরস্কারের যোগ্য মনে করা হয়।
হিসাব করলে দেখা যায় হান কাং–এর আন্তর্জাতিক পরিচিতি মোটের উপর দশ বছর। এতো কম সময়ের পরিচিতিতে নোবেল জেতার ঘটনা এটাই প্রথম বলা যায়। তাঁর ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ উপন্যাসটির জন্য আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে তিনি পরিচিতি পান ও প্রশংসিত হন। এই উপন্যাসে একজন নারীর মাংস খাওয়া বন্ধ করাতে পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের সংকটে পড়েন। এই সংকটকে কেন্দ্র করে মূলত উপন্যাস এগিয়ে যায়। তাঁর লেখায় সামাজিক সংকট, মানবতার অন্ধকার দিক এবং অস্তিত্বের জটিলতা উঠে আসে। তাঁর লেখা হিউম্যান অ্যাক্টস–এ তাঁদের পারিবারিক দুঃখ কষ্টের বিবরণ, জন্মের দুই ঘণ্টার মধ্যে তাঁর জন্মের আগে জন্ম, তাঁর বোনের মৃত্যুশোক, তাঁর মা–বাবা এমনকি তাঁকেও তাড়িত করেছে সেটার বর্ণনাও পাঠককে স্পর্শ করেছে। কিভাবে মা সন্তান জন্ম দিলেন নিঃসঙ্গ অবস্থায়, কিভাবে নাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করলেন, কিভাবে সেই শিশুটা তার কালো চোখ দিয়ে মায়ের দিকে তাকালো আর কিভাবে শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করলো! মায়ের মুখে একটাই আর্তি ছিল, মরে যেওনা, তুমি মরে যেওনা! কি অদ্ভুত সাদৃশ্য! তাঁর লেখায়ও এই বাক্যটি উচ্চারিত হয়েছে। অথচ তিনি জানতেন না মা তাঁর বোনের মৃত্যুর সময় একথাটা বারবার বলেছিলেন।
হান কাং–এর প্রিয় লেখক দস্তয়েভস্কি। আর কোরিয়ান লেখক লিমচুলউয়ে। হান কাং মনে করেন প্রতিটি লেখক শুধু কাহিনিকার নন বরং প্রত্যেক সৎ লেখক অন্তত প্রশ্নের উত্তরের খোঁজ করতে থাকেন। কিন্তু কেউ অভিষ্ট উত্তরের সন্ধান পান না। লেখকের জীবন প্রশ্নোত্তরের একটি অনন্ত অভিযাত্রা! তিনি তাঁর লেখায় অবচেতন ট্রমাকে এমন স্পষ্টতা ও সরলতার সাথে প্রকাশ করেছেন পাঠকেরা তার চরিত্রের ভেতর সহজে প্রবেশ করতে পারেন। মানুষের শরীর ও আত্মার এবং জীবিত ও মৃতের যোগাযোগ বিষয়ে হান কাং–এর সচেতনতা অসাধারণ। তাঁর গদ্য কাব্যিক ও নীরিক্ষাধর্মী। সমসাময়িক গদ্য সাহিত্যে তিনি নতুনধারা যুক্ত করেন।
হান কাং–এর জন্ম ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে। তাঁর বাবাও একজন জনপ্রিয় উপন্যাসিক। বাবার প্রভাব এবং শৈশবের বাবার বিশাল লাইব্রেরি তাকে লেখক হয়ে উঠতে অনুপ্রেরণা যোগায়। এবং ১৪ বছর বয়সে তিনি সিদ্ধান্ত নেন তিনি লেখক হবেন। মানুষ কি, ব্যক্তি মানুষ হয়ে উঠার প্রক্রিয়া কি, দুঃখ কেন মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এসবের উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছেন তাঁর লেখায়।
নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান আন্দ্রেস ওলসেন বলেন ঐতিহাসিক নানা যন্ত্রণাবিদ্ধ বিষয় ও অদৃশ্য অনুশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন হান কাং।
সামপ্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ কোরিয়ার সংগীত কে. পপ ব্যান্ড বিটিএস এর বিশ্বব্যাপি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়া ২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র ‘প্যারাসাইট’ অস্কার জিতে নিয়েছে। বলা যায় পৃথিবীব্যাপী সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় দক্ষিণ কোরিয়ার জয়জয়কার। এবার হান কাং–কে নোবেল পুরস্কার দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দিল সুইডিশ একাডেমি!