নোঙর তোলো তোলো

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

জাহাজ এবং মেরিন-সংক্রান্ত সবকিছুতেই নোঙর অপরিহার্য- মনোগ্রাম-সিম্বল, সাইনবোর্ড, লেটার-হেডিং, ড্রেসে-টুপিতে, কাঁধের উপরের এপোলেটে- এঙ্কোর থাকবেই। মেরিনারদের জাতীয়-সঙ্গীত ‘ওরে নীল দরিয়া’-র মতো, সুদূর সমুদ্রের মাঝে থেকেও আমাদের মনের নোঙর পড়ে থাকে নিজবাড়ির ভিতরে। কিন্তু জাহাজের আসল নোঙর তো ঠিক জায়গামত ফেলতে হবে। চলুন আজ নোঙর ফেলি।

কিছু জিনিস ধারে কাটে, আর কিছু কাটে ভারে। জাহাজের নোঙর এবং এর শিকল কিন্তু দুই গ্রুপেরই। ধারও লাগে, আবার ভারও লাগে। প্রথমেই কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার করে নেই। আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন- রাতের বেলায় কী জাহাজ চলে? নাকি, আপনারা রাতে নোঙর ফেলে, সকালে আবার যাত্রা শুরু করেন? উত্তর হলো জাহাজ দিনরাত চব্বিশ ঘন্টাই চলতে পারে। এক পোর্ট ছেড়ে অন্য পোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে, সেখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত চলবেই। গভীর সমুদ্রে নোঙর ফেলা হয় না। জেটিতে বাঁধা অবস্থায়ও নোঙর ফেলতে হয় না। দড়ি-কাছি দিয়ে জাহাজকে সামনে আর পিছন থেকে বেঁধে রাখা হয়। পোর্টের কাছে, অগভীর সমুদ্রে বা নদীতে নোঙর করা হয়; সেই থেকেই তো নাম ইনার এঙ্কোরেজ বা আউটার এঙ্কোরেজ। পতেঙ্গা যাওয়ার পথে, কর্ণফুলিতে দেখবেন আভ্যন্তরীণ ছোট ছোট জাহাজ নদীর মাঝে এঙ্কোর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে (ইনার এঙ্কোরেজ)। আবার পতেঙ্গা বিচে গেলে দূরে সমদ্রের দিকে দেখবেন অনেক সমুদ্রগামী বড় জাহাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে (আউটার এঙ্কোরেজ)। সেখানে নোঙর ফেলে জাহাজগুলো অপেক্ষা করে, কবে ভিতরে আসবে; অথবা চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়ে অন্য পোর্টে যাওয়ার পথেও, আউটারে থামতে পারে।

নোঙর দেখতে কেমন সে ধারণা তো সকলেরই অল্পস্বল্প আছে। অবশ্য নানান ডিজাইনের নোঙর আছে। নোঙরের কাজ হলো জাহাজকে একজায়গায় স্থির রাখা জোয়ার-ভাটা, বাতাস, স্রোত যাতে জাহাজকে অন্যস্থানে না নেয়। জাহাজী ভাষায় ড্রিফ্‌ট্‌ না করে। আদিযুগের জাহাজে ব্যবহার হতো ভারী-পাথর, বা বস্তাভর্তি পাথর, ভারী-কাঠ ইত্যাদি। সেগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে পানিতে নামিয়ে নোঙরের কাজ হতো। প্রস্তরযুগ থেকে লৌহযুগে প্রবেশের মতই, ধীরে ধীরে কাঠ-পাথরের বদলে ভারী-লোহার ওজনের ব্যবহার শুরু হলো। তারপরে এলো টেকনিক্যাল ডিজাইন- মানে শুধু ওজন দিলেই হবে না, সমুদ্র বা নদীর তলার মাটিকে আঁকড়ে ধরার মত করে বানানো শুরু হলো। জাহাজের সঙ্গে নোঙর বাঁধা হতো দড়ি (rode) দিয়ে। (লক্ষ্য করুন rode (রোড); রোপ নয়)। এখনো সাম্পানে-নৌকায় বা ছোটো বোটে, ইয়টে, দড়িই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, বড় সমুদ্রগামী জাহাজে লোহার শিকল। দড়ি-কাছি তো বেশিদিন টিকে না, সমুদ্রের পানি লেগে নরম হয়ে পঁচে যায়, ঘষা খেয়ে খেয়ে ছিঁড়ে যায়- ঠিকমত খেয়াল না করলে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটে। সেই তুলনায় লোহার চেইন অনেক মজবুত এবং টেকসই (অবশ্য অনেক অনেকগুণে দাম বেশী)। তবে জানমালের সেইফটির সঙ্গে তো টাকা-পয়সার তুলনা করা যায় না। লোহার চেইনের আরো একটা কার্যকারিতা আছে- এর ওজন। সে সম্পর্কে পরে বলছি।

ছোট জলযান, নৌকা-সাম্পান, বোট-ইয়টে দেখবেন লোহার তৈরি আঁকশি ধরনের নোঙর। বড়শির মত তিনটা বা চারটা হুক একসঙ্গে লাগানো। দড়ির একপ্রান্তে বেঁধে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। আবার তুলে নিয়ে, ডেকেরই কোনো জায়াগায় রেখে দেওয়া হয়। কিন্তু বড় জাহাজে দেখবেন, একদম সামনের দিকে (bow), দুইপাশে দুইটা এঙ্কোর সুন্দর করে বাঁধা আছে। সেগুলোকে জায়গামত ঠিক করে না বাঁধলে, ভারী লোহার এঙ্কোর জাহাজের সঙ্গে ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে নিজেও নষ্ট হবে, জাহাজের বডিকেও নষ্ট করবে, ট্যাপ খাবে, পেইন্ট তুলে দিবে। আজকাল যেই এঙ্কোর দেখেন, সেটাকে বলা হয় স্টকলেস এঙ্কোর। ১৮২০ সালের দিকে এটা শুরু হয়, তার আগ পর্যন্ত, প্রায় সতেরোশ-আঠারোশ বছর ফিশারম্যান বা এডমিরালটি এঙ্কোর ব্যবহার হতো। এই ফিশারম্যান বা এডমিরালটি এঙ্কোরে স্টক বলে একটা ডান্ডা থাকতো নোঙরের চোখা ফলার সঙ্গে নব্বই ডিগ্রী এঙ্গেল করা। এই স্টকের কারণে সেগুলোকে ব্যবহার করতে বেশ বেগ পেতে হতো। আর পানি থেকে তুলে জাহাজে রাখার সময়েও কষ্ট হতো।

এখনকার যুগের স্টকলেস এঙ্কোর (Stock-less Bower anchor) অনেক সুবিধার। মাঝখানে একটা মোটা ডান্ডা থাকে, শ্যাঙ্ক (shank); এর দুইপাশে তিনকোনা, কিছুটা সূচালো দুইটা ফ্লুক (fluke) বের হয়ে গেছে। এগুলোই মাটিতে গেঁথে যায়। ফ্লুকের চওড়া অংশ (shoulder), মাটিতে গাঁথতে সাহায্য করে। ফ্লুক বামে-ডানে বেশ কয়েক ডিগ্রী নড়তে পারে। এডমিরাল্টি এঙ্কোরে সেটা সম্ভব ছিলো না। এই যে ফ্লুক নড়ে, এর জন্যেই এঙ্কোর পানির তলায় মাটিতে ঠেকলে, হাল্কা একটু উপরে টেনে তারপরে পিছের দিকে টানলে, ফ্লুকের চোখা অংশ তীরের ফলার মত মাটিতে গেঁথে যায়- পিছের দিক থেকে যতই টানবেন সেটা ততই গাঁথতে থাকবে।

আচ্ছা এঙ্কোর আর চেইন তো শুনলাম, সেটা কীভাবে উঠানো-নামানো হয়? ঠিক আছে, ঘুড়ি, সূতা এবং লাটাই চিন্তা করুন। এঙ্কোর যদি ঘুড়ি হয়, চেইন যদি তার সূতা হয়, তাহলে লাটাইও লাগবে-এক্ষেত্রে হাল্কা ঘুড়ির মত আকাশে উড়ার বদলে, আমাদের এঙ্কোর লোহার ওজনে পানিতে ডুববে। উইঞ্চ (winch) হলো একধরনের লাটাই- ক্রেনে লক্ষ্য করে দেখবেন, যার মধ্যে স্টিলের রোপটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ক্রেনের হুক উঠানামা করা হয়। জাহাজের ক্রেনও আছে, আবার জেটির সঙ্গে জাহাজ বাঁধার জন্যেও উইঞ্চ আছে। তবে জাহাজের একদম সামনে, দুইপাশের দুইটা এঙ্কোরের জন্যে উইঞ্চের মতই একটা করে খুবই শক্তিশালী উইন্ডল্যাস (windlass) থাকে, যেগুলো ইলেক্ট্রিক মোটর বা হাইড্রোলিক মোটর দিয়ে চলে। জাহাজের একদম সামনের দিককে, আমরা বলি ফোক্সেল (fore-castle-এর সংক্ষিপ্ত রূপ)। ফোক্সেলে একটা চেইন-লকার থাকে; সেখানে শিকলের শেষপ্রান্ত জাহাজের বডির সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা থাকে। যদিও, ইমার্জেন্সিতে, একটা পিন খুলে, শিকলকে পুরাপুরি পানিতে ‘জলাঞ্জলি’ দেওয়া যেতে পারে। লক্ষ লক্ষ টাকার সলিল সমাধি হবে। সেই চেইন-লকার থেকে বের হয়ে শিকলটা একটা বড় উইঞ্চ বা ড্রামের উপর দিয়ে যায়- এর নাম উইন্ডল্যাস। এটা ভীষণ শক্তিশালী ও ভীষণ জোরে ঘড়ঘড় আওয়াজ করে ঘুরে। এটা ঘুরে ঘুরেই এঙ্কোরকে উঠায় নামায়। উইন্ডল্যাসের সামনে জিপসি উইল থাকে। সেখান দিয়ে গিয়ে হস্‌-পাইপের (hawsepipe) মধ্য দিয়ে বাইরে বের হয়ে পানিতে গিয়ে পড়ে। অনেক সময়ে দেখবেন এই হস্পাইপ দিয়ে অঝোরধারায় পানি পড়ছে। এটাকে বলে এঙ্কোর ওয়াশিং- এঙ্কোর যখন তুলা হয়, সেটা এবং তার চেইন নদী/সমুদ্রের কাদামাটি, ময়লা সহ উঠে আসে, তাই তুলবার সময়ে পানি ছেড়ে দিয়ে পরিষ্কার করা হয়।

কিন্তু আগেই বলেছি ভার বা ওজনের ব্যাপারও আছে। সেটা শুধু এঙ্কোরের ওজন না, শিকলের ওজনই হলো প্রধান। লোহার তৈরি শিকলগুলো খুব ভারী হয়- এর একটা রিং তুলতে গেলেই আমার আপনার জান বের হয়ে যাবে। যত লম্বা করে শিকল নামানো যাবে, ততই ওজন। প্রথমেই এঙ্কোর নামিয়ে দেওয়া হলো, সেটা সমুদ্র বা নদীর তলে ঠেকলে, ধীরে ধীরে আরো চেইন ছাড়তে ছাড়তে জাহাজকে পিছিয়ে আনুন। এঙ্কোরের ফ্লুকের চোখা অংশ মাটিতে গেঁথে বসবে। এরপরে আরো চেইন ছেড়ে দিয়ে জাহাজকে ক্রমাগত পিছে নিয়ে যান- সেই চেইনের কিছু অংশ সমুদ্রতলে থাকবে, আর বাকীটুকু কিছুটা অক্ষরের মত হয়ে ঝুলবে, জাহাজ আর মাটির মাঝে (catenary)। কত লম্বা করে চেইন নামানো হলো তার একটা হিসাব আছে- স্থানকালপাত্র ভেদে এর হিসাব করতে হয়। কোন্‌ ধরনের এঙ্কোরিং-স্পট, তাৎক্ষণিক আবহাওয়া কেমন, বাতাস-স্রোত কেমন, আশেপাশে অন্য জাহাজ আছে কিনা, জাহাজ খালি না মাল-বোঝাই, আরো অনেক অনেক কিছুর হিসাব করেই তবে এঙ্কোর করা হয়। চেইন যখন উইন্ডল্যাস দিয়ে ছাড়া হয়, তখন খেয়াল রাখা হয়। প্রতি নব্বই ফুট পর পর শিকলে দাগ দেওয়া আছে। যত দাগ গেলো, তাকে নব্বই দিয়ে গুণ করলেই পেয়ে যাবেন কত লম্বা করে চেইন ছাড়া হয়েছে।

নোঙর তো ফেললেন, এবারে তুলতে হবে না? উপরের পদ্ধতির উল্টাটা করলেই হয়ে যাবে। জাহাজকে আস্তে আস্তে সামনের দিকে ঠেলতে থাকুন, আর সুন্দর করে শিকল তুলে নিয়ে চেইন লকারে ভরে ফেলুন। একদম জলের মতই সোজা- খালি যারা এগুলো করে, তারা সেই কথা মানতে চায় না। সত্যি কথা কি জানেন – সমুদ্রগামী জাহাজের এঙ্কোর ফেলা ও তুলা হলো খুবই বিপজ্জনক কাজ। অনেক অনেক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু হয়েছে এটা করতে গিয়ে। আর মাঝে মাঝে এঙ্কোরেরও মৃত্যু হয় – পানির তলে পাথরে আটকে গেলে, বা শিকল পেঁচিয়ে গেলে ইত্যাদি। তখন লক্ষ লক্ষ টাকার এঙ্কোরকে বিদায় দিতে হয়।

টলিডো, ওহাইও, ২০২২
refayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোটারি ক্লাব অব গ্রেটার চিটাগাংয়ের সভা
পরবর্তী নিবন্ধপশ্চিমাদের দুর্বল বললেন জেলেনস্কি