সময় মাত্র ৩০ সেকেন্ড। এ সময়ের মধ্যেই তাদের হাতে মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ তুলে দিতে হবে। নয়তো এলোপাথাড়ি ছুরিকাঘাত করে তারা হাতিয়ে নেবে মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন। অপেক্ষারত সিএনজি টেক্সিতে চেপে ছুট, মোবাইল বিক্রি করতে পুরাতন রেল স্টেশনের চোরাই মার্কেটে যেতে হবে, সেখান থেকে বিক্রির টাকা নিয়ে যেতে হবে বগার বিল; কিনতে হবে ইয়াবা। ইয়াবায় সুখটান দিয়ে তবেই শান্তি! আর ছিনতাইকারীদের এ গ্রুপগুলোর নেতৃত্বে আছে নারী! নগরীতে ইয়াবার টাকা জোগাড়
করতে নৃশংস ছিনতাইকারীদের দুইটি চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর এ তথ্য বের হয়েছে। কোতোয়ালী থানা পুলিশ গত মঙ্গলবার নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ দুটি চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তবে আরো একটি চক্র এখনো অধরা রয়ে গেছে।
গত ১৬ নভেম্বর রহমতগঞ্জের একটু সামনে সিএনজি টেক্সি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে এক তরুণী। মোবাইল হাতে এক পথচারী পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ওই তরুণী পথচারীকে সামনে থেকে আগলে ধরতেই তার সঙ্গে থাকা আরেক তরুণ ছোরা দিয়ে পথচারীকে আঘাত করে। একপর্যায়ে গুরুতর জখম পথচারীর হাত থেকে মোবাইলটি ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। ধারালো ছুরির আঘাতে পথচারীর একটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং বুকে ও পেটে তিনটি আঘাত পান। এর আগে নগরীর জামালখান এলাকায় একজনের কাছ থেকে মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
পরদিন ১৭ নভেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নগরীর চকবাজার এলাকায় একজনের কাছ থেকে মোবাইল ছিনতাই করে। এরপর রাত ৮টার দিকে সার্সন রোডে সিজিএস স্কুলের পাশে আগের দিনের মতো ছুরিকাঘাত করে সেলিম নামে এক যুবকের মোবাইল ফোন নিয়ে চলে যায়। নগরীর জয় পাহাড়ের ভেতর দিয়ে কর্মস্থল থেকে ফিরছিলেন সেলিম। সার্সন রোডে সিজিএস স্কুলের পাশে আসা মাত্রই সিএনজি টেক্সি থেকে নেমে সেলিমের পথরোধ করে এক তরুণী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্য এক তরুণ সেলিমের বুকে, পেটে ও উরুতে এলোপাথারি ছুরিকাঘাত করে। এরপর তার মোবাইল ফোন নিয়ে অপেক্ষারত সিএনজি টেক্সিতে চেপে পালিয়ে যায় তারা। গত তিন দিনে নগরীতে এ ধরনের অন্তত সাতটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দুটি ঘটনায় গুরুতর জখম হয়ে দুজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন আজাদীকে বলেন, গত ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় নগরের গনি বেকারি মোড়ে ছিনতাইয়ের শিকার হন অরবিন্দু দত্ত নামে এক ব্যক্তি। এ সময় ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। ঐ ঘটনায় উৎপল দত্ত নামের এক ব্যক্তি কোতোয়ালী থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ পেয়ে প্রথমে ভুক্তভোগীর মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করা হয়। যার কাছ থেকে ফোনটি উদ্ধার করা হয়, তাদের দেয়া তথ্যে আমরা একটি গ্রুপকে ধরি। ওই গ্রুপে এক নারীসহ চার পুরুষ সদস্য আছে। এরা হলো- রুবেল, ফারজানা, রাজু, আলআমিন ও আব্দুল নাঈম। প্রথমে আমরা ভেবেছি, রহমতগঞ্জের ঘটনায় এ গ্রুপটি জড়িত। পরে দেখি না, এরা অন্য জায়গায় একই কায়দায় কাজ করলেও রহমতগঞ্জের ঘটনায় তারা জড়িত নয়। আবারো অভিযান শুরু করি এবং একপর্যায়ে নিপা গ্রুপের নিপা ও রাকিবকে গ্রেপ্তার করি। তবে তাদের গ্রুপের আরেক সদস্য রাশেদ এখনো পলাতক।
ছিনতাইয়ের কৌশল সম্পর্কে ওসি মহসীন বলেন, নিপা প্রেমিকা আর রাকিব প্রেমিক পরিচয়ে ঘুরোঘুরির জন্য ঘণ্টায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বিনিময়ে সিএনজি টেক্সি ভাড়া করে। তাদের সাথে থাকা রাশেদ বন্ধু সেজে চালকের পাশে বসে। ঘুরতে ঘুরতে তারা ‘শিকার’ পেয়ে গেলে তার সামনে গিয়ে সিএনজি টেক্সি থামায়। এসময় সিএনজি থেকে নেমে নিপা পথচারীর সাথে কথা বলতে চায় বা তাকে ধরে রেখে ব্যস্ত রাখে। এই সুযোগে রাকিব ছুরির ভয় দেখিয়ে এবং ছুরিকাঘাত করে পথচারীর মোবাইল বা টাকা-পয়সা কেড়ে নেয়। এ ঘটনা দেখে চালক কোনো কারণে বিগড়ে গেলে তার পাশে বসে থাকা রাশেদ ছুরির ভয় দেখিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে বাধ্য করে। চকবাজার থানার প্যারেড কর্নার, কলেজ রোড, চট্টেশ্বরী রোডের সার্সন রোড, কোতোয়ালী ও চকবাজার থানার সীমানা রেখা জামালখান, গুডস হিলের সামনে, গনি বেকারী এলাকায় তারা এসব ঘটনা ঘটায়।
বগারবিল ও দেওয়ানবাজার এলাকায় বসবাস করে রাকিব, নিপা ও রাশেদ। একই এলাকায় বড় হওয়ার সুবাদে পূর্ব থেকেই জানাশোনা আছে তাদের মধ্যে। রূপালী রূপা প্রকাশ নিপা নগরীর দিদার মার্কেট এলাকার ফারুক টাওয়ারের একটি বাসায় কাজ করত। সে সন্ধ্যার আগেই কাজ থেকে ফ্রি হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর রাকিব আর রাশেদকে নিয়ে শুরু করে তার অভিযান। একবছর আগে থেকে ইয়াবা সেবন শুরু করে তারা। ইয়াবার টাকা জোগাড় করতে জড়িয়ে পড়ে ছিনতাইয়ে। ছিনতাই থেকে অর্জিত অর্থ তারা মাদক সেবন ও আনন্দ ফুর্তিতে ব্যয় করত। নিপা এর আগে তার মামা সুমনের সঙ্গে মিলে নগরীতে অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে। নিপার মামা সুমন মুরাদপুরে এক দারোয়ানকে ছুরিকাঘাত করে জেলে আছে। এরপর থেকে রাশেদ আর রাকিবের সঙ্গে ছিনতাই শুরু করে নিপা।
অরবিন্দু দত্তকে ছুরিকাঘাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নিপা জানায়, সোমবার সন্ধ্যায় নিপা বাসা থেকে বের হয়। ফোনে যোগযোগ করে রাকিব ও রাশেদের সঙ্গে। তারা দেওয়ানবাজারে আসার পর তিনজন মিলে ৩০০ টাকায় একটি সিএনজি টেক্সি এক ঘণ্টার জন্য ভাড়া করে। প্রথমে জামালখানে একজনের কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে স্টেশন রোডে গিয়ে ২৬০০ টাকায় বিক্রি করে। এরপর আরেকটি টেক্সি ভাড়া নিয়ে আন্দরকিল্লা দিয়ে এসে রহমতগঞ্জ কুসুমকুমারি স্কুলের সামনে থেকে অরবিন্দু দত্তকে অনুসরণ করা শুরু করে। অরবিন্দু ঢালু সড়কের ওপর দিয়ে হেঁটে ওঠার সময় রাকিব ও নিপা নেমে তার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে মোবাইল দেওয়ার জন্য বলে। কিন্তু অরবন্দিু রাকিবকে জাপটে ধরে ফেলার পর তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে আবারও টেক্সিতে উঠে স্টেশন রোডে চলে যায়। ঘটনার সময় রাশেদ চালকের পাশে বসে তাকে নজরদারিতে রেখেছিল। সেই মোবাইল তিন হাজার টাকায় বিক্রি করে। নিপা ও রাকিব ২ হাজার টাকা করে পায় এবং রাশেদকে দেওয়া হয় ১৬০০ টাকা। এরপর তিনজন মিলে ৬টি ইয়াবা কিনে নগরীর দেওয়ান বাজারে একটি নির্মাণাধীন ভবনে যায়। সেখানে ইয়াবাগুলো সেবন করে নিপা ফিরে যায় যেখানে কাজ করেন সেই বাসায়। পরদিন সন্ধ্যার দিকে আবারও ‘একটু আসছি’ বলে বের হয়ে নিপা রাকিব ও রাশেদের সঙ্গে মিলে ছিনতাই করে।
রাকিব এক সময় চকবাজার এলাকার ছিঁচকে চোর ছিল। প্যারেড মাঠে খেলতে আসা ছেলেদের মোবাইল চুরি করতো। একবছর আগে সকালে প্যারেড কর্ণারে প্রাতঃভ্রমণে যাওয়া এক লোকের মোবাইল চুরির পর তাকে গণধোলাই দেওয়া হয়েছিল। এরপর সে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেয়। কিন্তু মাদকাসক্ত হওয়ায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে নিপাদের সঙ্গে মিলে ছিনতাই শুরু করে রাকিব।