নেগেটিভ রিলের স্মৃতি, ডিজিটাল ক্লিকের দাপট

সনেট দেব | সোমবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

স্মৃতির ভেতর কিছু জিনিস থাকে-যা সময়ের ধুলোয় যতই ঢেকে যাক, হৃদয়ের ভাঁজ থেকে কখনও মুছে যায় না। অ্যানালগ ক্যামেরার যুগ সেরকমই এক সোনালি সময়; পুরোনো টিনের ট্রাঙ্ক খুললে যখন বিবর্ণ সাদা-কালো ছবিগুলো হাতে এসে পড়ে, তখন যেন শুধুই কাগজ নয়-আঙুলে ধরা পড়ে এক ভুলে যাওয়া জীবনের নরম উষ্ণতা। সেই ছবিগুলোতে লুকিয়ে থাকে আমাদের বেড়ে ওঠার রাস্তা, সেই গ্রীষ্মের দুপুর, সেই শীতের কুয়াশা, সেই লাজুক হাসি আর হারানো মুখগুলোর নীচুস্বরে ফিসফিস করা গল্প। তখন একটি ছবি তোলা মানে ছিলো এক ছোট্ট যাত্রা-সাজগোজ, প্রস্তুতি, ভরসাহীন উত্তেজনা, তারপর শাটার নামার ‘টক্‌’ শব্দে জমে ওঠা অপেক্ষা। এক নেগেটিভ ডেভেলপ হওয়া পর্যন্ত অস্থির সেই প্রত্যাশা-ছবি কেমন আসবে? আলো কি ঠিক পড়েছে? চোখ কি খোলা ছিল?-এসবই ছিলো আমাদের জীবনের ক্ষুদ্র হলেও উজ্জ্বল আনন্দের অংশ।

আজকের অবিশ্বাস্য সহজ পৃথিবীতে সেই অভিজ্ঞতাগুলো প্রায় গল্প হয়ে গেছে। মোবাইল হাতে নিতেই ছবি; সঙ্গে সঙ্গে দেখা, এডিট, না পছন্দ হলে সেকেন্ডেই ডিলিট-স্মৃতিও যেন এখন ভোগ্যপণ্য, ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়ার মতো সহজ। অথচ একসময় একটি ছবিই ছিলো বিশেষ দিন, ছোট উৎসব, ধৈর্যের পরীক্ষা, আর সযত্নে রাখা এক মূল্যবান মুহূর্ত। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো ছিলো খানিক লাজুক, খানিক গর্বের দৃশ্য-কারণ ছবিটি বছর না হোক, যুগ পেরিয়ে থাকবে অ্যালবামের পাতায়। তাই অ্যানালগ ফটোগ্রাফি শুধু প্রযুক্তির ইতিহাস নয়; এটি আমাদের শৈশবের আলোছায়া, হারানো পৃথিবীর গন্ধ, আর সময়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা নস্টালজিয়ার উষ্ণ এক স্মৃতিকথা। ছবি হয়তো বদলেছে, মাধ্যম বদলেছে-তবু যে অনুভবগুলো তখন তৈরি হয়েছিল, সেগুলো আজও আমাদের অতল স্মৃতিতে বেঁচে আছে অনন্ত আলো হয়ে।

একসময় ক্যামেরা ছিল না আজকের মতো সবার হাতে থাকা সহজলভ্য যন্ত্র। ঘরে যদি কোনো ক্যামেরা থাকতও, সেটা হতো বিদেশফেরত কারো আনা মূল্যবান সম্পদ, কিংবা পরিবারের কোনো দায়িত্ববান কাকার কাছে যত্নে রাখা ‘সম্মানিত বস্তু’। সেই ক্যামেরাকে কেন্দ্র করেই ঘরে তৈরি হতো এক ধরনের নিয়ম-এটা মুছে রাখো, শুকনো জায়গায় রাখো, রোদে নিয়ো না, বাচ্চাদের হাতে দিও না-যেন এটি ঘরের কোনো আদরের সদস্য। আর ছবি তোলার দিনগুলো ছিল যেন উৎসবের মতো; ঈদ, পিকনিক, স্কুল অনুষ্ঠান, অথবা হঠাৎ সবাই একসাথে হলে শোনা যেতো চিরচেনা বাক্য-“চল, ছবিটা তুলি, নাহলে আবার কবে সবাই একসাথে হব!”

একটিমাত্র ছবি তুলতেই আবেগ, আয়োজন আর প্রতীক্ষার ঢেউ বয়ে যেতো। কারণ এটি ছিল আগামী কয়েক মাস-কখনো কখনো কয়েক বছরের-স্মৃতি ধরে রাখার একমাত্র মাধ্যম। আজ আমরা দিনে শত ছবি তুললেও, তখন একটি ছবি মানে ছিল জীবনের অমূল্য মুহূর্তকে ধরে রাখার গভীর, নিবিড় আনন্দ। ফটোগ্রাফার তখন শুধু ক্যামেরাম্যান ছিলেন না-তিনি ছিলেন এক ধরনের জাদুকর। তাঁর হাতে ঝুলে থাকা ভারী Yashica, Konica, Nikon FM, Canon AE-1 বা Zenit ক্যামেরা যেন এক বিমূর্ত ক্ষমতা ধারণ করত।

স্টুডিওর ডার্করুমের লাল আলো যেন এক রহস্যময় জগত, যেখানে ছবি জন্ম নিতো। ফটোগ্রাফার ফিল্ম ধুয়ে তুলতেন, Developer ও Fixer এর গন্ধে ঘর ভরে যেত। টংকার ধাতব ক্লিপে ঝুলে থাকা নেগেটিভের সারি-এগুলোই ছিল ছবির জন্মের প্রথম স্তর। কাজটি ছিল বিজ্ঞান আর শিল্পের মিশেল; ফিল্মকে রাসায়নিকের মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে ডুবিয়ে তুলতে হতো সতর্কভাবে, নয়তো স্মৃতি চিরতরে হারিয়ে যেত। নেগেটিভ থেকে পজিটিভ ছবি ছাপানো আরও সূক্ষ্ম শিল্প; হালকা বেশি হলে ছবি সাদা, কম হলে কালো। ফটোগ্রাফারের হাতের দক্ষতায় সেই মুহূর্ত দৃশ্যমান হতো কাগজে। প্রতিটি ছবির পেছনে লুকিয়ে থাকত অগণিত পরিশ্রম, ধৈর্য ও সময়ের নীরব স্তুতি।

ক্যামেরার ইতিহাসও আসলে মানুষের স্মৃতি সংরক্ষণের ইতিহাস। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকরা ‘Camera Obscura’-র ধারণা দিয়েছিলেন-ছিদ্র দিয়ে বাইরে দৃশ্য উল্টো প্রতিফলিত হতো। ১৮২৬ সালে জোসেফ নিসেফোর নিয়েপ বিশ্বের প্রথম স্থায়ী ছবি তুলেছিলেন টিনের পাতায় আলোর রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ব্যবহার করে। পরে লুই দাগেরি তৈরি করেন ‘ড্যাগুয়েরিওটাইপ ক্যামেরা’, যা প্রথম বাণিজ্যিক ক্যামেরা প্রযুক্তি। ১৮৮৮ সালে জর্জ ইস্টম্যান তৈরি করেন Kodak-You press the button, we do the rest. ” এরপর SLR ক্যামেরা, ৩৫ মিলিমিটার ফিল্ম, লেন্সের বিবর্তন এবং পরে ডিজিটাল সেন্সর-প্রতিটি ধাপে মানুষের স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতাকে আরও সহজ করে তুলেছে।

ছবি তোলা এক জিনিস, আর সেই ছবি হাতে পাওয়ার মুহূর্ত যেন এক সম্পূর্ণ অন্য পৃথিবী। তখন রিলে থাকতো মাত্র ২৪ বা ৩৬টি ফ্রেম-তার বেশি নয়, আর প্রতিটি ফ্রেম ছিল তার নিজের এক মূল্য, এক মর্যাদা। ভুল ক্লিক মানে ছিল একটি স্মৃতি চিরতরে হারানো, তাই ক্যামেরা খুলে রিল ভরার সময় বুকই ধড়ফড় করত-একট-খানি আলো ঢুকে গেলেই সব নষ্ট! এরপর ছবি তোলার পর রিল স্টুডিওতে জমা দেওয়ার পর শুরু হত সেই চিরচেনা অপেক্ষা। সপ্তাহজুড়ে ফোন আসত

-“ভাই, নেগেটিভটা ভেসে উঠছে না?”

-“আরেকটু সময় লাগবে, ধোয়ার কাজ চলছে…”

-অপেক্ষার সেই সময়গুলোই যেন নিজের মধ্যে একটি আলাদা আবেগ হয়ে উঠত। ছবি দেখা মানে ছিল যেন একটি চিঠি খোলা, যার ভেতর লুকানো থাকে বিস্ময়, আনন্দ, আড়াল ছাপা গল্প। আজকের মতো সঙ্গে সঙ্গে দেখে ফেলার সুবিধা তখন ছিল না, তাই ছবি তোলার মুহূর্তে সবাই থাকত ভীষণ সচেতন, ভীষণ পরিপাটি, মনে মনে ধারণ করত-একটি ফ্রেমই বহন করবে পুরো মুহূর্তের স্মৃতি, এক জীবনের ছোট্ট ইতিহাস।

প্রতিটি বাড়িতে থাকত মোটা, কালো বা লাল রঙের অ্যালবাম-মাঝে মাঝে পাতাগুলো খসখসে হয়ে যেত, তবুও সেগুলো ছিল অমূল্য। এক অ্যালবাম খুললেই যেন অতীতে ফিরে যাওয়া; মায়ের শৈশব, বাবার ছাত্রজীবন, গ্রামের বাড়ির উঠোন, শৈশবের ঈদ, প্রথম পিকনিক, প্রথম স্কুলের দিন-সবই একসাথে ফুটে উঠত। অ্যালবাম একা বসে দেখা যেত না; এটি এক ধরনের ছোট উৎসব, যেখানে পরিবার ঘিরে বসত, একেকটি ছবি দেখাতে দেখাতে হাসি আর স্মৃতির গল্প ভেসে যেত। আজকের ডিজিটাল গ্যালারি সেই অভিজ্ঞতাকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না; আমরা এখন হাজারো ছবি তুলি, কিন্তু খুব কম সংরক্ষণ করি। অ্যানালগ যুগে ছবি কম ছিল-তাই প্রতিটি ছবি ছিল সত্যিই মূল্যবান, প্রতিটি ছবি ছিল জীবনের এক ছোট্ট ইতিহাস।

২০০০ সালের পর ডিজিটাল ক্যামেরা বাজারে দাপিয়ে উঠল। কেউ আর নেগেটিভ ডেভেলপ করতে চাইল না। মেগাপিক্সেলের প্রতিযোগিতা-৮, ১২, ৫০ মেগাপিক্সেল-স্মৃতি রক্ষার প্রক্রিয়াকে তাৎক্ষণিক করে তুলল। পছন্দ না হলে মুছে ফেলা সম্ভব। ছবির সঙ্গে সঙ্গে দেখা-এটাই বদলে দিলো আমাদের ধৈর্যের প্রকৃতি। অ্যানালগের গভীরতা, সীমাবদ্ধতা ও অনিশ্চয়তা এড়িয়ে সহজে ছবি তোলার আনন্দে সবাই মেতে উঠল। মোবাইল ক্যামেরা এলে সব বদলে গেল। স্মার্টফোনে ৫০ মেগাপিক্সেল, নাইট মোড, এআই প্রসেসিং, পোর্ট্রেট ব্লার-সবই হাতের মুঠোয়। ফটোগ্রাফি আর শুধু ছবি তোলা নয়; এটি হয়ে গেছে সামাজিক ভাষা। আমরা নথিভুক্ত করছি-যে খাবার খাচ্ছি, রাস্তায় হাঁটছি, নোট লিখছি, হাসি মুখে ফুটছে-প্রতিটি মুহূর্ত। একদিনে হাজারো ছবি, মুহূর্তে স্মৃতি তৈরি আর হারানো। অ্যানালগের সীমিত ৩৬ ফ্রেমের রোল থেকে আমরা এসে পৌঁছেছি মুহূর্তের বিশাল বন্যার মধ্যে-সহজ, কিন্তু সেই গভীর আবেগ, ধৈর্য ও নস্টালজিয়া আজ হারিয়ে গেছে।

আজ এক মোবাইলে হাজার হাজার ছবি-এক সেকেন্ডে তুললেই পরের সেকেন্ডে শেয়ার করা যায়। ভুল হলে মুছে আবার নেওয়া যায়-ছবির কোনো স্থায়ী মূল্যই যেন থাকে না। এখন ক্যামেরা আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী; কখনও ক্ষুধা তাড়ানোর আগে খাবারের ছবি, কখনও দেখা হওয়া মুহূর্তের সেলফি, আবার কখনও কেবল বিরক্তি কাটানোর অদ্ভুত মুহূর্ত। এই সহজলভ্যতা আমাদের সৌন্দর্যের মূল্যবোধকে কি কমিয়ে দিয়েছে! কারণ যা সহজলভ্য, তা কখনও আগের মতো গভীর আবেগ, প্রতীক্ষা এবং স্মৃতির মায়া ধারণ করতে পারে না; হারিয়ে গেছে সেই জাদু, যা এক ফ্রেমে জমিয়ে রাখত পুরো জীবনের ক্ষুদ্রতম মুহূর্তকেও।

পুরোনো অ্যালবাম খুললেই আজও চোখে অশ্রু আসে। যে দাদু, যাকে আর পাওয়া যায় না-তিনি হয়তো হাসছেন এক ফ্রেমের ভেতরে, স্থির হয়ে থাকা সেই হাসিতে জীবনের মধুর স্মৃতি লুকিয়ে আছে। যে দিনগুলো আর ফিরে আসবে না-সেগুলো যেন সাদা-কালো পাতার ভেতরে চুপচাপ লুকিয়ে আছে, আমাদের ছুঁয়ে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। একটি পুরোনো ছবি যেন নিজেই বলে-“আমরা হারাইনি… সময় শুধু এগিয়ে গেছে।” ডিজিটাল যুগ যতই দ্রুত এগোক, অ্যানালগ ছবির সেই স্পর্শ-যা আঙুলে ছুঁয়ে দেখার মতো উষ্ণতা দেয়-ফিরে পাওয়া যায় না। কারণ সেখানে শুধু ছবি নয়, আছে মানুষের পরিশ্রম, সময়ের ধৈর্য, স্মৃতির গন্ধ এবং হারিয়ে যাওয়া জীবনের নীরব স্তুতি, যা একটি বোতামে ক্লিক করার মধ্য দিয়ে কখনও ধরা যায় না।

অ্যানালগ ফটোগ্রাফি আমাদের শেখায়-একটি ছবি কেবল দৃশ্য নয়, এটি একটি জীবনের ছোট্ট, নিখুঁত টুকরো। প্রতিটি ফ্রেম হয়ে ওঠে সময়ের সাক্ষী, অনুভূতির দলিল, এবং কালের ভেতর জমে থাকা মানুষের অদৃশ্য গল্প। আজ আমরা ডিজিটালের সুবিধা উপভোগ করি-ছবির সহজলভ্যতা সত্যিই বিস্ময়কর। কিন্তু সেই সুবিধার মাঝেও যদি আমরা এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়াই, ছবিকে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি, হারানো স্মৃতির প্রতি আবার সময় দিই-তাহলে হয়তো হারিয়ে যাওয়া অ্যানালগ যুগের উষ্ণতা, ধৈর্য, এবং গভীর আবেগ নতুন করে আমাদের হৃদয়ে ফিরে আসবে। সেই অনুভূতি-যা কেবল চোখে নয়, মনে, হাতে এবং হৃদয়ের স্পর্শে অনুভূত-এখনও আমাদের স্মৃতির পাতায় মৃদু আলো ছড়ায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিহঙ্গপ্রেমী নিষ্পেষিত মানুষের বন্ধু আলম
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে ভোরে আওয়ামী লীগের তিন মিনিটের মিছিল