‘সবচেয়ে যে ছোট্ট কাপড় গুলি, সেই গুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে/ যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট, আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে/ সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল, সেই গিয়েছে সবার আগে সরে/ ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে, সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে’( ছিন্নমুকুল–সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)। কবিতার প্রতিটি লাইন আমাদের অনুভূতিকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। ঘরে একজন ছোট্ট সদস্যের অনুপস্থিতির শূন্যতা ঘিরে ধরে। আমাদের দেশের পরিবারগুলোই এমন। মা–বাবার আদর, বোনের মমতা, ভাইয়ের ভালোবাসা, গুরুজনদের শাসন সোহাগ সব মিলেই আমরা থাকতে ভালোবাসি।
অনেক আশার আলো নিয়ে মা–বাবার ঘরে সন্তানের আগমন ঘটে। সে সন্তান ছেলে কিংবা মেয়ে হোক, সে মা–বাবা ধনী কিংবা গরীব হোক। পৃথিবীর সকল পিতা মাতার বহু প্রত্যাশিত ও স্নেহের আধার তাদের সন্তানেরা। সন্তানের চোখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন তারা। স্নেহ, আদরে, লালনে–পালনে কোনো ত্রুটি রাখতে চান না। আজকাল সমাজের এ চিত্র যেন ভিন্ন দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ আজ গণমাধ্যমের প্রতিটি পাতায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টগুলোতে।
কী হচ্ছে না? খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, দলীয় কোন্দল, পাড়ায় বড় ভাইদের নামে আস্ফালন, কিশোর গ্যাং নামে বিপথগামী সংঘবদ্ধ চক্রের আক্রমণ, ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, পারিবারিক ও বৈষয়িক কোন্দল, আত্মহত্যা (প্রেমঘটিত থেকে যে কোনো কারণ), বাল্যবিবাহ আরো কত কী! এসব চিত্র দেখতে দেখতে জনজীবন আজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বিচার হবে, শাসন হবে, উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন হবে এই করে করে সময়ের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত জীবন। যথোপযুক্ত শাসন ও বিচার হচ্ছে না বলে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে হিংগ্রেরে দল। লোলুপ দৃষ্টি এসে পড়ছে কোমলমতি শিশুদের ওপর। যে শিশু বাবার কোলে ঘুরে বেড়ায়, মায়ের আঁচলে শান্তিতে ঘুমায়, সে শিশু আজ পাশবিক ও নারকীয় হত্যার শিকার হচ্ছে। কোথায় আমাদের দণ্ডদাতা? বছরের পর বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা আজও কোনো মাধ্যমে আমরা পাইনি। যে শাস্তি দেখে অপরাধীরা সাহস করবে না, সেই শাস্তি কোথায়?
২০১৯ সালে শিশু ধর্ষণের মাত্রা ছিল পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে আশঙ্কাজনক ও ভয়াবহ। ২০১৯ সালে যেখানে ৪৪৮ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে সেখানে ২০১৮ সালে ছিল ৪১৮, ২০১৭ সালে ছিল ৩৩৯ এবং ২০১৬ সালে ২৬৫ জন শিশু খুন হয়েছে (দৈনিক অধিকার)। ২০১৯ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা অতিক্রম করেছিল এক হাজার। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৮৪টি শিশু ধর্ষিত হচ্ছে। সার্বিক শিশু নির্যাতন কিছুটা কমলেও শিশুদের প্রতি যৌন নির্যাতন বেড়েছে আশঙ্কাজনক মাত্রায়। ( তথ্য– বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম)। আমরা ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে যে চিত্র দেখতে পাই সেখানে ক’জন ধর্ষক উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে? ধরা যাক, যদি ধর্ষকরা ২০১৯ সাল থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেত তবে আজ ২০২৩ সালে এসে শিশু ধর্ষণ বা অত্যাচারের ঘটনা লিখতে হতো না। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশে শিশু অধিকার রক্ষায় BSAF কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু লক্ষ্মীপুরের সেই হীরামনি থেকে শুরু করে শারমিন, আজকের বর্ষা, আয়াত, আয়নীদের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছে কি?
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেই ধর্ষণের শিকার ৫৪ নারী শিশুর মধ্যে ১২ জনই কন্যা শিশু (দৈনিক ভোরের কাগজ)। মহিলা পরিষদের জরিপ অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৪৪ নারী ও শিশু। যাদের মধ্যে ২৪ জনই কন্যা শিশু! (দৈনিক সমকাল)
নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয়ের করালগ্রাসে বলি হচ্ছে আমাদের অবুঝ কন্যা সন্তানেরা। পাশবিক লালসা এমন স্তরে এসে নেমেছে যেখানে সমগ্র জাতি আজ আতঙ্কিত। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, অনলাইন নির্ভরতার কারণে অনেকেই নিজের মস্তিস্কজাত বুদ্ধি বিবেচনা ও নৈতিকতাকে ভুলতে বসেছে। অনেকে অপরাধ সংগঠনের জন্য শিশুদের বেছে নেয়, আবার হীনইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য শিশুদের টার্গেট করা হয়। পরিবারের বড় সদস্যদের প্রতিশোধ নিতেও ছোট শিশুকে টার্গেট করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘মানুষের দুর্বল জায়গায় আঘাত করার জন্য অনেক সময় শিশুদের উপর নির্যাতন করা হয়ে থাকে। এটি যেমন মানসিক বিকারগ্রস্ততা, তেমনি নৈতিক অবক্ষয়। এসব কারণে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন বেড়েছে। এক্ষেত্রে পুলিশি নির্লিপ্ততার সুযোগ নেয় অপরাধীরা’ (দৈনিক জনকণ্ঠ)।
উইমেন আই ২৪ ডেস্ক–থেকে জেনেছি ২০২২ সালের প্রথম আট মাসেই ৫৭৪ জন কন্যা শিশু ধর্ষিত হয়েছে। ধর্ষকরা কোথায়? শাস্তি কোথায়? লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ না দিয়ে লোমহর্ষক শাস্তির বিধান করুন। সমাজের মাথায় যারা দণ্ড নিয়ে বসে আছেন, আশা করবো সেই দণ্ড সঠিক দিকে চালনা করবেন। সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার বিকল্প নেই। পাড়ায় মহল্লায় শিশু কিশোরদের জন্য প্রগতিশীল সংগঠনের ব্যবস্থা করে দিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার আওতায় প্রতিটি পাড়া ও মহল্লায় শিশুদের বাধ্যতামূলক অংশ গ্রহণের ব্যবস্থা করে দিন। এমন সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে দিন যেন আগামীকাল থেকে আমার দেশের কোনো গণমাধ্যমেই শিশুধর্ষণ ও শিশু হত্যার মত খবর প্রকাশ করতে না হয়। নয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাই যথার্থ বলে প্রতীয়মান হবে ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না। আড়ম্বর করি, কাজ করি না। যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না। যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না’ (জন্মেতে বঙ্গসন্তান)।
লেখক : গল্পকার ও শিক্ষক