আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা(আইইউসিএন)-এর রেড লিস্টের ‘লিস্ট কনসার্ন’ বা বাংলাদেশের পরিবেশে অত্যন্ত উদ্বেগজনক পর্যায়ের তালিকায় থাকা নীল সাতারু কাঁকড়া বা ব্লু সুইমিং ক্র্যাব-এর বাণিজ্যিকভাবে পোনা উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছেন কক্সবাজারস্থ
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট(বিএফআরআই)-এর সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র-এর বিজ্ঞানীরা।
বর্তমানে শীলা কাঁকড়ার পাশাপাশি নীল সাতারু কাঁকাড়াও গ্রেড অনুযায়ী স্খানীয় রেস্তোরাঁয় সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে বিক্রি হচ্ছে এবং জনপ্রিয় সি-ফুড হিসেবে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
অধিক চাহিদার কারণে প্রকৃতি থেকে নীল সাতারু কাঁকড়ার আহরণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশে এর সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। কাঁকড়া সমুদ্র উপক‚লের দূষণ পরিষ্কারকারী ‘মেইন বায়োটার্বেটর’ বা জৈব রাসায়নিক পরিবর্তনকারী প্রধান প্রাণী হিসাবে বিবেচিত।
কাঁকড়া বায়োটার্বেশনের মাধ্যমে মাটির ভৌত ও জৈব-রাসায়নিক গুণাগুণের বা বৈশিষ্টের পরিবর্তন ঘটিয়ে খাদ্য সার্কেলের বিভিন্ন জীব-অনুজীব ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার মত পরিবেশ তৈরি করে। সৈকতের মাটির লবণাক্ততাও হ্রাস করে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে প্রকৃতি থেকে কাঁকড়া আহরণের কারণে আমাদের পরিবেশ থেকে এসব উপকারী প্রাণি হারিয়ে যেতে বসেছে। জানান, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, “অতি আহরণ থেকে সমুদ্র সম্পদের সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রাখতে চলমান ২০২১-২২ অর্থসালে বিএফআরআই’র উদ্যোগে কক্সবাজারে নীল সাতারু কাঁকড়ার প্রজনন ও পোনা উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এরই অংশ হিসাবে গত ডিসেম্বর থেকে ইতোমধ্যে তিন ব্যাচে সাতারু কাঁকড়ার ডিম থেকে পোনা ফোটানো হয়েছে। সেই বাচ্চা এখন কেন্দ্রের হ্যাচারিতে প্রতিপালিত হচ্ছে।”
নীল সাতারু কাঁকড়ার প্রজনন ও পোনা উৎপাদন প্রকল্প এর প্রধান গবেষক, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আহমেদ ফজলে রাব্বি বলেন, প্রত্যেক ব্যাচে প্রায় ৩ লাখ করে পোনা দিয়েছে। এরমধ্যে ডিসেম্বরে প্রথম ব্যাচের পোনা এখন ক্র্যাবলেট পর্যায়ে এবং গত ১৫ ফেব্রæয়ারি দেওয়া তৃতীয় ব্যাচের পোনা জুইয়া-২ পর্যায়ে ও গত ৭ ফেব্রæয়ারি দেওয়া দ্বিতীয় ব্যাচের পোনা জুইয়া-৩ পর্যায়ে রয়েছে। পোনাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে এখনও প্রায় ৬০% ভাগ পর্যন্ত বেঁচে আছে। যা বিজ্ঞানীদের মাঝে বিশাল প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, সমুদ্র সম্পদের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য কক্সবাজারে নীল সাতারু কাঁকড়ার (Portunus pelagicus) প্রজনন ও পোনা উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “বিদেশে শীলা কাকঁড়ার পাশাপাশি নীল সাতারু কাঁকড়ার জনপ্রিয়তা ও চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শীলা কাকঁড়ার তুলনায় নীল সাতারু কাঁকড়ার স্বজাতীভূজী (Cannibalism) স্বভাব তুলনামূলক কম থাকার কারণে তার পোনা উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা সহজ। এই অবস্থায় সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও অতি আহরণ থেকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং দেশের সুনীল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উন্নয়ন, পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য নীল সাতারু কাকঁড়ার বাণিজ্যিক প্রজনন কৌশলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করছি।”
কাঁকড়া খামারীরা চাইলে বিএফআরআই থেকে নীল সাতারু কাকঁড়ার পোনা সংগ্রহ করতে পারবেন বলে জানান বিএফআরআই মহাপরিচালক।
বিজ্ঞানীরা জানান, কাঁকড়া একটি নিখুঁত ও অবিকল্প পরিবেশ প্রকৌশলী। একটি নিখুঁত স্থপতি, ভ‚-রাসায়নিক প্রকৌশলী, জৈবিক প্রকৌশলী, ভৌত প্রকৌশলী ও জলবায়ু প্রকৌশলী। কাঁকড়া ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য জালগুলিতে একটি মূল পরিবেশগত সংযোগ তৈরি করে। মাটিতে থাকা জৈব পদার্থের বন্টন পরিবর্তন ঘটায়। পলিতে থাকা বিভিন্ন প্রাণীর খাবার উন্মুক্ত করে, খাবারের গুণগত পুষ্টিমান বাড়িয়ে তুলে। এছাড়া মাটিতে লবণাক্ত কমায় এবং পানিতে কার্বন সরবরাহের মাধ্যমে অগভীর সামুদ্রিক জলজ পরিবেশের পানির কলামে রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।