সামুদ্রিক ঝড়–জলোচ্ছ্বাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ঠেকাবে নীল কার্বন! সেসাথে উপকূলীয় অঞ্চলে তৈরি করবে নতুন নতুন বাস্তুসংস্থান। সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মূলী গাছপালা, জোয়ার–ভাটার জলাভূমি, ম্যানগ্রোভ ও সমুদ্র ঘাসকে ‘নীল কার্বন’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। স্থলভিত্তিক বনাঞ্চলের চেয়ে এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল প্রায় পাঁচ গুণ বেশি হারে কার্বন ডাই অক্সাইড সংরক্ষণ করতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রে আয়োজিত ‘বার্ষিক গবেষণা অগ্রগতি (২০২৪–২৫) পর্যালোচনা ও গবেষণা প্রস্তাবনা (২০২৫–২৬) চূড়ান্তকরণ’ শীর্ষক এক আঞ্চলিক কর্মশালায় এ তথ্য জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. শেখ আফতাব উদ্দিন।
‘টেকসই মৎস্য চাষ ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ম্যানগ্রোভের প্রয়োজনীয়তা’ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, সমুদ্র উপকূলীয় উদ্ভিদ বা ম্যানগ্রোভ বনের বাস্তুতন্ত্রগুলিতে প্রতি ইউনিট ক্ষেত্রের ভিত্তিতে উচ্চ হারে কার্বন জমা হয় এবং শেকড়ের মাধ্যমে তা মাটি ও পলিতে সঞ্চিত থাকে। এই উদ্ভিদগুলো তাদের জীবন্ত জৈববস্তুতে এবং মাটির উপরের মিটারে হেক্টর প্রতি গড়ে ৩৯৪ মেট্রিক টন কার্বন ধারণ করে। তবে ফিলিপাইনের মতো কিছু অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বন হেক্টর প্রতি গড়ে ৬৫০ মে. টনেরও বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড ধারণ করতে পারে। তিনি বলেন, ম্যানগ্রোভ বন অনেক অ–জলবায়ু সুবিধাও প্রদান করে এবং বাস্তুতন্ত্র–ভিত্তিক অভিযোজনে অবদান রাখতে পারে। এ বনে প্রচুর পরিমাণে বৈচিত্র্যময় প্রজাতির বাসস্থান রয়েছে; যা এর সংলগ্ন জলাভূমি, নদী এবং স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন করে। তবে যদি এই বাস্তুতন্ত্রগুলো অবনতিপ্রাপ্ত হয় বা হারিয়ে যায়, তাহলে এর জমাকৃত কার্বন বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাওয়ার আশংকা থাকে।
ড. আফতাব বলেন, বর্তমানে কার্যকর নীল কার্বন বাস্তুতন্ত্র, অর্থাৎ ম্যানগ্রোভ, সমুদ্র ঘাসের তৃণভূমি এবং জোয়ার–ভাটা জলাভূমি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়, যেগুলো কার্বন ডাই অক্সাইড ধারণ করে ও সঞ্চয় করে এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে সরাসরি অবদান রাখে। তিনি বলেন, নীল কার্বন বাস্তুতন্ত্রের টেকসই ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু কর্মকাণ্ড ছাড়াও বিস্তৃত পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করে। নীল কার্বন বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার ও টেকসই ব্যবস্থাপনা এখন একটি প্রকৃতি ভিত্তিক শক্তিশালী সমাধান বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের কেন্দ্র প্রধান ও মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন। কর্মশালায় বঙ্গোপসাগরের মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা, প্রজনন প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে ১১টি গবেষণা প্রকল্প উপস্থাপন করা হয়।
ড. শফিক বলেন, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, কক্সবাজার এর বিজ্ঞানীরা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নিরলসভাবে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই গবেষণার আওতায় আওতায় সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য নির্ধারণ, মাছের মজুদ নিরূপণ, বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির প্রজনন সময়কাল চিহ্নিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য এসেছে। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে বেহুন্দি জালের ফাঁস নির্ধারণ, নিরাপদ শুটকি উৎপাদন, আর্টেমিয়া চাষ, হাইব্রিড মাছ ও চিংড়ি চাষ, কেজ ও ফ্লোটিং কালচারে সামুদ্রিক মাছ ও মোলাস্ক চাষ, সীউইড টিস্যু কালচার ও লাইভ ফিড উৎপাদন ইত্যাদি। তিনি বলেন, বর্তমানে লাইভফিড (ফটোবায়োরিএক্টর) প্রকল্পের মাধ্যমে হ্যাচারি পর্যায়ে বিশুদ্ধ অ্যালজি স্টক ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবন, মেরিকালচার প্রকল্পের আওতায় উপকূল এবং ল্যান্ডবেইজড ইন্ট্রিগ্রেটেড মাল্টিটপিক একুয়াকালচার, সামুদ্রিক মাছের মজুদ নিরুপণ প্রকল্পের আওতায় টুনা এবং ম্যাকেরেল মাছের মজুদ নিরুপণ, নীল সাঁতারু কাঁকড়া প্রকল্পের আওতায় সাঁতারু কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন, নার্সারী ও চাষ ব্যবস্থাপনা, ব্রিডিং প্রকল্পের আওতায় সীবাস/কোরাল মাছের মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদন এবং ভ্যালু অ্যাডেড প্রকল্পের আওতায় ভ্যালু অ্যাডেড ফিশ প্রডাক্ট ও ক্যান প্রডাক্ট উৎপাদন ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
নতুন প্রস্তাবনায় সামুদ্রিক হ্যাচারি শিল্পে ব্যাকটেরিয়াল রোগ নিয়ন্ত্রণে দেশীয় প্রযুক্তি উন্নয়ন, সী–উইড ব্যবহারের মাধ্যেমে অ্যাগার ও ক্যারাজিনান তৈরি, নীল সাঁতারু কাঁকড়ার চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ক্রোকার ফিশারীজের মজুদ নিরুপণ ইত্যাদি বিষয়ে উপস্থাপনা করা হয়।
দিনব্যাপি এই কর্মশালায় বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মৎস্য সহ অন্যান্য সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, হ্যাচারি মালিক, মৎস্যচাষী, উদ্যেক্তবৃন্দ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালায় বলা হয়, নীল কার্বন সংরক্ষণের মাধ্যমে মৎস্য চাষ ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের অভাবনীয় উন্নতি সাধন করা যায়।