‘চট্টগ্রামের ভালো কাজের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভাষাসৈনিক প্রয়াত বদিউল আলম চৌধুরী। সমাজের প্রতি যে দায়িত্ব সেটা তিনি পালন করেছেন যথার্থভাবে। দূরদর্শী রাজনৈতিক ও প্রগতিশীল চিন্তানায়ক বদিউল আলম চৌধুরী আজীবন নিষ্ঠাবান সমাজসেবী, অক্লান্ত শিক্ষা প্রচারক ও বিজ্ঞানমনস্ক স্বদেশপ্রেমী হিসেবে সমাজের জন্যে, দেশের জন্যে কাজ করে গেছেন। এ কারণে তাকে চট্টগ্রামবাসী চাটগাঁর এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণ করেন। দলমত নির্বিশেষে সমাজে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তিনি। নীতি আদর্শের ব্যাপারে আমৃত্যু অবিচল ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সাল হতে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী সংগঠন ‘তমুদ্দুন মজলিস’–এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ভাষা, শিক্ষা ও সমাজসেবায় ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী যে অবদান রেখে গেছেন তা ইতিহাসে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। গতকাল সন্ধ্যায় নগরের লালদিঘীর দক্ষিণ পাড়ে সিটি কর্পোরেশন মাহবুব উল আলম চৌধুরী পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে ভাষা সৈনিক মরহুম বদিউল আলম চৌধুরীর ১৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ‘স্মরণ সভায়’ এসব কথা বলেন বক্তারা। ভাষা সৈনিক মরহুম বদিউল আলম চৌধুরীর মৃত্যবার্ষিকী উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত স্মরণ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী, নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক সদস্য এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর ড. নাজিমউদ্দীন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্বা সংসদ চট্টগ্রামের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা শাহাবউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী, সিডিএর বোর্ড মেম্বার জাহিদুল করিম কচি। সভাপতিত্ব করেন উদযাপন পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক কাজী শাহাদাত হোসাইন।
ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আজকে বদিউল আলম চৌধুরীর বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক আলোচনা হয়েছে। আমরা যদি এগুলো আত্মস্থ করতে পারি, আত্মস্থ করে যদি সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সেটাকে ইমপ্লিমেন্ট করতে পরি তবেই এর সার্থকতা।
তিনি বলেন, বদিউল আলম সাহেবরা সবসময় সবকিছু বাদ দিয়ে দেশের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি ভাষা আন্দোলন কেন করেছিলেন? আমি উর্দু ভাষা চাই না, আমার মুখের ভাষা হচ্ছে বাংলা, সেটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না–এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন।
ডা. শাহাদাত বলেন, যখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল তখন মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছে। কাজেই সব মিলিয়ে আমরা মনে করি, আমাদেরকে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়াই করে যেতে হবে, যেভাবে বদিউল আলম সাহেবরা করেছেন। এই লড়াই যদি আমরা করতে পারি এবং শেষ পর্যন্ত আমরা টিকে থাকতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের এই সোসাইটিকে, এই শহরকে, এই দেশকে আমরা রক্ষা করতে পারব।
তিনি বলেন, আগামী রোববার আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হবে। আমাকে দাওয়াত দিতে আসছিলেন। সেখানে কথা উঠেছে, মসজিদের তিন একর জায়গা এখন এক একর হয়ে গেছে। বাকি দুই একর কারা নিয়ে ফেলেছে? আশেপাশে যারা আছে তারা। দেখবেন এদের মধ্যে কেউ রাজনীতিবিদ আছেন, কেউ ধর্মীয় নেতা আছেন। ডা. শাহাদত বলেন, আমরা নিজেরা দেশ শাসন করতে চাই, শহরের মেয়র কিংবা শাসক হতে চাই, কিন্তু আমরাই আবার জায়গাগুলো দখল করে ফেলছি। ধরেন, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি। যেটা সিটি কর্পোরেশনের। কিন্তু ক্ষমতা বলে ১৬ সাল থেকে এটা নিজের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছে। যেটা আমি এসে উদ্ধার করেছি। তিনি বলেন, আমি মেয়র আজকে আছি। কাল কিন্তু জনগণ না চাইলে থাকব না। জনগণ আমাকে বসিয়েছে তাদেরকে সেবা দেওয়ার জন্য। কিন্তু এ কথাটা আমরা ভুলে যাই। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়ায়–মেয়র মানে সবকিছু আমার। যেটা উচিত না।
ডোর টু ডোর ময়লা অপসারণ কার্যক্রম বেসরকারি খাতে দেয়া প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, এ প্রক্রিয়ায় যদি জনগণ অসন্তুষ্ট হয় সেটা আমি ক্যান্সেল করব। তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদীর দূষণ হয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে বারবার বলা হচ্ছে, কর্ণফুলী নদীকে রক্ষা করেন। আপনার সব ময়লা আপনি কালেকশন করেন। সব ময়লা কালেকশন করতে হলে তো আমাকে ঘর থেকে ময়লা আনতে হবে। ঘর থেকে ময়লা আনার জন্য তো জনগণ আমাকে ট্যাঙ দিচ্ছে না। আমাকে ট্যাঙ দিচ্ছে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে ময়লা কালেকশন করে সেকেন্ডারি গার্বেজ স্টেশনে ফেলার জন্য। কিন্তু মানুষ নির্দিষ্ট স্পটে ময়লা ফেলে না। বিদেশে গেলে বাসার ময়লাটা নিজে নিজে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখি। কিন্তু এখানে করি না। আসলে দেশপ্রেম থাকতে হবে। শহরের প্রতি দায়িত্ব থাকতে হবে। শহরের প্রতি মমত্ববোধ থাকতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দূষণমুক্ত শহর রেখে যেতে হবে।
আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, চট্টগ্রাম কিছু কিছু মানুষের জন্য গর্ব করতে পারে। ভাষাসংগ্রামী বদিউল আলম চৌধুরী তেমনি একজন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত জমিদার বাড়ির সুযোগ্য উত্তরাধিকার। যুগে যুগে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কিছু মানবসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। যাদের ত্যাগ, সৃষ্টিশীলতার দানে, কর্মে মানবসমাজ উপকৃত হয়। সেই কীর্তিমানরা স্থান করে নেন ইতিহাসে। দেশবরেণ্য সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী, মানবদরদী ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন বদিউল আলম চৌধুরী।
এম এ মালেক বলেন, বদিউল আলম চৌধুরী ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী। বলা যায়, দূরদর্শী রাজনৈতিক, আজীবন নিষ্ঠাবান সমাজসেবী, প্রগতিশীল চিন্তানায়ক, অক্লান্ত শিক্ষা প্রচারক ও বিজ্ঞানমনস্ক স্বদেশপ্রেমী বদিউল আলম চৌধুরী ছিলেন গত শতাব্দীর চট্টগ্রামের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শেষ পর্যন্ত এদেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলীর অনেক ক্ষেত্রে তার অংশগ্রহণ ছিল। তিনি বলেন, ব্যক্তি হিসাবে বদিউল আলম চৌধুরী যেমন আধুনিক ছিলেন, তেমনি ছিলেন সৃষ্টিশীল। দেশের প্রতি ছিল অপরিসীম ভালোবাসা ও অনুরাগ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একাধিক শিক্ষা, সেবা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বহু শিক্ষা, সেবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রাখেন। সদালাপী, বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, ধার্মিক, মানবতাবাদী এই মানুষ চিন্তা চেতনায় ছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক। আমি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, সমাজ এবং দেশের প্রতি আব্বার যে কন্ট্রিবিউশন তা আব্বার মৃত্যুর পর জানতে পারি। শিক্ষার প্রতি ওনার যে ভালোবাসা সেটা সন্তানের মধ্য দিয়েও প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি বলেন, জেন্ডার সমতা সেটা পরিবার থেকে আসতে হয়। আমার বাবার মধ্যে সেটা দেখেছি। কলম দিয়ে দেশসেবার বিষয়টি বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। তিনি বলেন, যারা দুর্নীতি করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেন। কিন্তু টোটাল সিস্টেমটা ড্যামেজ করবেন না।
এরশাদ উল্লাহ বলেন, বদিউল আলম চৌধুরী একজন ভাষাসৈনিক। আমরা যদি আমাদের স্বাধীনতাকে স্মরণ করি, তাহলে দেখব এই ভাষার মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। এটা আমরা সকলে স্বীকার করি। ভাষার জন্য যারা এই অনন্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে একজন বদিউল আলম চৌধুরী। আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষার যে স্বীকৃতি সেটা এই ভাষাসৈনিকদের অবদান। ওনারা ভাষার জন্য অনন্য উদাহারণ সৃষ্টি করেছেন।
অধ্যাপক কাজী শাহাদাত হোসাইন বলেন, ভাষা আন্দোলন না হলে বাঙালির অস্তিত্ব থাকতো না। এ ভাষার জন্য লড়াই করেছেন বদিউল আলম চৌধুরী।
প্রফেসর ড. নাজিম উদ্দিন বলেন, মহান ব্যক্তিত্ব, চট্টগ্রামে গর্ব করার মত এমন মানুষ খুব কমই রয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ওনার সান্নিধ্য পড়েছে। তিনি আমাদের অহংকার, অলংকার। এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, বদিউল আলম চৌধুরী ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি একজন ভালো পিতাও।
স্মরণসভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হারুন জামান ও ইয়াছিন চৌধুরী লিটন, সদস্য কামরুল ইসলাম, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম চট্টগ্রামের সদস্য সচিব আহমদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী (সাজ্জাদ), টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা বেলায়েত হোসেন, কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক জয়নাল আবেদীন চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তাহেরা বেগম, সহকারী প্রধান শিক্ষক অসিত দাশ পুলক। সঞ্চালনা করেন কাজী খোরশেদ আলম, প্রশান্ত কুমার পান্ডে ও জায়েদ বিন রশিদ।