নিয়োগের তথ্য নেই তবুও বাড়ছে শ্রমিক

প্রতি মাসে ২ কোটি বেতন পরিশোধ চসিকের ডোর টু ডোর প্রকল্প

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্ন বিভাগে ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে ২ হাজার ৬৫ জন শ্রমিক কর্মরত আছে। সাতটি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতি মাসে তাদের ২ কোটি ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৭ টাকা বেতনও পরিশোধ করা হচ্ছে। অথচ এসব শ্রমিকের নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো তথ্য সংস্থাটির পরিচ্ছন্ন বিভাগ ও সচিবালয় শাখায় নেই। এমনকি শ্রমিকদের কাছেও নিয়োগপত্র নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে যেসব ধাপ অনুসরণ করা হয়, তা পুরোপুরিভাবে মানা হয়নি ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্পের শ্রমিক নিয়োগে। অথচ গত চার বছর ধরে প্রতি মাসে গাণিতিক হারে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। নিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন নথি পর্যালোচনায় জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২টি শর্তে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্পের জন্য দুই হাজার শ্রমিক নিয়োগের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় চসিককে। ওই হিসেবে বর্তমানে অতিরিক্ত শ্রমিক ৬৫ জন। এছাড়া শর্তগুলোর একটি ছিল, নিয়োগ প্রদানের এক মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রেরণ করতে হবে; যা বাস্তবায়ন হয়নি। পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ফরম্যাটে নিয়োগকৃত শ্রমিকদের ছবিসহ ৭ ধরনের তথ্য সংরক্ষণের কথা থাকলেও তা নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২১ জুলাই জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় কাজ নাই মজুরি নাই ভিত্তিতে দুই হাজার পরিচ্ছন্নতা কর্মী চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় চসিক। পরবর্তীতে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৭১৭ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালে ৯৫ জন, ২০১৯ সালে ১৮৩ জন এবং চলতি বছর ৬৯ জন নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে ৫৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
নিয়োগ নিয়ে নানা প্রশ্ন : দৈনিক আজাদীর অনুসন্ধানে জানা গেছে, কর্মরত শ্রমিকরা বিভিন্ন সময়ে সাদা কাগজে আবেদন করেন। যা তৎকালীন মেয়র ‘ব্যবস্থা নিন’ বলে প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা বরাবর মার্কিং করে দেন। এর প্রেক্ষিতেই তারা কাজ করছেন। অবশ্য ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল এসব শ্রমিকদের ‘সম্পূর্ণ অস্থায়ী সেবক হিসেবে নিয়োগ পত্র’ দেয়ার জন্য অফিস আদেশ হলেও তা কার্যকর হয়নি।
সাধারণত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করা হয়। এর মধ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, আবেদনপত্র গ্রহণ ও যাচাই-বাছাই শেষে তালিকা তৈরি, নিয়োগ কমিটি গঠন, লিখিত অথবা মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ, নিয়োগ কমিটির সভা এবং ওই সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ, নিয়োগাদেশ, নিয়োগপত্র অথবা যোগদান পত্র প্রদান এবং প্রত্যেক শ্রমিকের বিপরীতে সচিবালয় শাখা থেকে পৃথক পৃথক নথি খোলা; যা ডোর টু ডোর প্রকল্পে শ্রমিক নিয়োগে পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চসিকের পদস্থ এক কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, শ্রমিক নিয়োগে পত্রিকায় শুধুমাত্র ২০১৬ সালে একবার বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কিন্তু বাকি বছরগুলোতে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, একজন আবেদনকারী কিভাবে জানতে পেরেছে চসিকে শ্রমিক লাগবে। বা কিসের ভিত্তিতে তিনি আবেদন করেন। আবার সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের আবেদনপত্র মেয়রের সামনে কে উপস্থাপন করেছে। অবশ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকেই চসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তৎকালীন অনেক কাউন্সিলরের আত্মীয়স্বজন বলে প্রচার আছে।
যোগ্যতা নেই তবু সুপারভাইজার : পরিচ্ছন্ন বিভাগ নিয়ে চসিকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হারুন নামে একজন সেবক পদে নিয়োগের জন্য আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন ২০১৩ সালে অষ্টম শ্রেণি পাশ করেছেন। পরে আবার ১৯৯৯ সালে দাখিল পাশ করেছেন বলে সনদ জমা দেন। বর্তমানে তিনি পরিচ্ছন্ন সুপারভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ এ পদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা দরকার এইচএসসি বা সমমান।
একই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে সাইফুল নামে এক পরিচ্ছন্ন সুপারভাইজারের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ করেন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্ট্যান্ডিং কমিটির তৎকালীন সভাপতি। এর প্রেক্ষিতে একই বছরের ২৩ জুন তাকে কারণ দর্শানো হয়। কিন্তু কিছুদিন পর তাকে পরিদর্শকের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিষয়টি অধিদকতর তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গাণিতিক হারে বেড়েছে শ্রমিক সংখ্যা : ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুলাই মাস পর্যন্ত ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্পের শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া বেতন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতি মাসে গাণিতিক হারে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। যেমন, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক হাজার ৬৯৪ জন শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করা হয় ১ কোটি ৫৫ লাখ এক হাজার ৮২৬ টাকা; যা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক হাজার ৭৯০ জন শ্রমিকের বিপরীতে ১ কোটি ৬৮ লাখ ৬৫ হাজার ৮২০ টাকা। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এক হাজার ৯৯৮ জনের বিপরীতে ২ কোটি ১৬ লাখ ৯৫ হাজার ৯৬১ টাকা এবং জুলাই মাসে দুই হাজার ১২ জন শ্রমিকের বিপরীতে ২ কোটি ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৭ টাকা জমা হয়েছে।
জানা গেছে, সাতটি ব্যাংকের মাধ্যমে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করে চসিক। এর মধ্যে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখায় ৩২৯ জন, এবি ব্যাংকের আন্দরকিল্লাহ শাখায় ৩১৩ জন ও দেওয়ান হাট শাখায় ৫৭৭ জন, সোনালী ব্যাংকের টেরিবাজার শাখায় ২৯২ জন, জনতা ব্যাংকের সিরাজদ্দৌলা শাখায় ১৮৬ জন, অগ্রণী ব্যাংকের প্রেস ক্লাব শাখায় ১৭৯ জন এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের সিডিএ শাখায় ১৩৬ জন শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, কিছু অনিয়ম আছে। অনিয়মগুলো চিহ্নিতকরণে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে চেষ্টা করছি। এজন্য প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মুফিদুল আলমকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছি। রিপোর্ট পাওয়ার পর অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।
তিনি আরো বলেন, শ্রমিদের সংখ্যা এপ্রুভ করা আছে, কিন্তু কারো নাম এপ্রুভ করেনি। এতে কে কাজ করছেন বা কে করছেন না-সেটার তথ্য অস্পষ্ট থাকে। নাম এপ্রুভ না থাকায় অনেক ছেলে-মেয়েকে দেখানো হয়েছে, যারা হয়তো কাজই করছে না। তাই আমি নির্দেশ দিয়েছি, প্রতিটি শ্রমিকের নাম, ঠিকানা, ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য ডকুমেন্ট জমা দিতে। এতে বাধ্য হয়ে কাজে যোগ দিতে হবে। অন্যথায় চিহ্নিত হবে।
চসিকের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. মোরশেদুল আলম চৌধুরী বলেন, সচিবালয় শাখায় জনবল কম থাকায় পরিচ্ছন্ন বিভাগ বিল তৈরি করে হিসাব শাখায় প্রেরণ করে। বেতন শিটে সবার নাম ঠিকানা উল্লেখ থাকে। সেখানে সংশ্লিষ্ট সবার স্বাক্ষরও আছে। তিনি বলেন, মেয়র মহোদয় নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি কোন পদ্ধতিতে দিয়েছেন, সেটা তো আমাদের জানার কথা না।
ডোর টু ডোর প্রকল্প কি : সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদকালে ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্পের মাধ্যমে বাসা-বাড়ি থেকে সরাসরি ময়লা সংগ্রহ শুরু হয়; যা ওই সময় প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পরবর্তীতে ৩ ধাপে ৪১ ওয়ার্ডে কার্যকর করা হয়েছে প্রকল্পটি। ওই কার্যক্রমের আওতায় বিকেল ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত প্রতিটি বাসা-বাড়ি থেকে সরাসরি ময়লা সংগ্রহ করছে চসিকের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। আর তা রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত নির্দিষ্ট আবর্জনাগারে ফেলা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহে ৯ লাখ ছোট বিন ও ৩ হাজার ৪৩০টি বড় বিন বিভিন্ন বাসা-বাড়ি, শিক্ষা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে নতুন শনাক্ত আরও ৭৭ জন
পরবর্তী নিবন্ধজমির ক্ষতিপূরণ দুর্নীতিতে জড়িত দেড়শ দালাল