পরিবেশবাদীরা বলছেন, শব্দদূষণ এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এখন একে ‘শব্দ-সন্ত্রাস’ নামে অভিহিত করা যায়। অপদস্থ হওয়ার ভয়ে বেশির ভাগ মানুষ কোথাও অভিযোগ না করে নির্বিবাদে উচ্চশব্দের ভয়ংকর যন্ত্রণা সহ্য করছেন। শব্দদূষণ একধরনের মারাত্মক পরিবেশদূষণ। আমাদের সঠিক অনুধাবনের অভাবে দিন দিন এই দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এই ‘শব্দ-সন্ত্রাস’ আমাদের মাথাব্যথার কারণ।
বিশেষজ্ঞরা বললেন, ‘শব্দদূষণের মতো সরব ঘাতক আর নেই। সাধারণভাবে আমরা যে শব্দ চাই না, সেটাই শব্দদূষণ। মানুষ ও প্রাণীর শ্রবণসীমা অতিক্রম করে এবং শ্রবণশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সে শব্দকেই শব্দদূষণ হিসেবে জেনে থাকি।’
দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্সের তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বের বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। তার অন্যতম প্রধান কারণ শব্দদূষণ। এই দূষণ এখন রাজধানী বা নগরেই সীমাবদ্ধ নেই, উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সম্প্রতি সমন্বিত একটি অংশীদারিমূলক কর্মসূচির আওতায় সারা বাংলাদেশে, বিশেষ করে আটটি বিভাগীয় সদরের শব্দদূষণের পরিমাপ করে। সেখানে দেখা যায়, শব্দদূষণের জন্য মূলত গাড়ির হর্ন সবচেয়ে বেশি দায়ী।
গত ১ ফেব্রুয়ারি ‘নগরীর ৩০ স্পটে ভয়াবহ শব্দদূষণ!’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আজাদীতে। এতে বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল স্পটগুলোকে নীরব এলাকা ধরা হয়। এসব এলাকায় শব্দের মানমাত্রা হচ্ছে ৪৫ ডেসিবল। কিন্তু নগরীর এ ধরনের ১৫ স্পটে দেড়গুণের বেশি মাত্রায় শব্দদূষণ হচ্ছে। গত ডিসেম্বরে সংগৃহীত নমুনা অনুযায়ী পাহাড়তলী গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৭৬.৬ ডেসিবল, ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সামনে ৭৪.৫ ডেসিবল, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) সামনে ৭৮.৫ ডেসিবল, চিটাগাং গভর্মেন্ট গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৬৮.৬ ডেসিবল, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি স্কুলের (বাওয়া) সামনে ৭৮.৫ ডেসিবল, ডা. খাস্তগীর গভর্মেন্ট গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৭৫.৫ ডেসিবল, চট্টগ্রাম কলেজের সামনে ৭৮.৫ ডেসিবল, সিটি কলেজের সামনে ৬৭.৬ ডেসিবল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সামনে ৭৫.৫ ডেসিবল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু মেডিকেল কলেজের সামনে ৬৭.৬ ডেসিবল, আন্দরকিল্লা জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে ৭১.৫ ডেসিবল, লালখান বাজার মমতা ক্লিনিকের সামনে ৭৭.৫ ডেসিবল, একে খান আল আমিন হসপিটালের সামনে ৭৬.৫ ডেসিবল, পাঁচলাইশ সার্জিস্কোপ হসপিটালের সামনে ৭৩.৫ ডেসিবল, পূর্ব নাসিরাবাদের সাদার্ন হসপিটালের সামনে ৬৯ ডেসিবল মাত্রায় শব্দের তীব্রতা পাওয়া যায়। তাছাড়া আবাসিক এলাকায় শব্দের মানমাত্রা ৫০ ডেসিবল হলেও নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ৬৫ ডেসিবল, আমিরবাগ আবাসিকে ৬৭.২ ডেসিবল, হালিশহর কে-ব্লক আবাসিকে ৬৯ ডেসিবল, কল্পলোক আবাসিকে ৬৬.৫ ডেসিবল, হিলভিউ আবাসিকে ৬৭ ডেসিবল, কসমোপলিটন আবাসিকে ৬৭.৫ ডেসিবল ও খুলশী (দক্ষিণ) আবাসিকে ৭৬.৫ ডেসিবল শব্দের তীব্রতা পাওয়া যায়। আবার মিঙড এরিয়া হিসেবে মানমাত্রা ৬০ ডেসিবল থাকার কথা হলেও মুরাদপুর একুশে হাসপাতালের সামনে ৬৯.৫ ডেসিবল ও মেহেদীবাগ ম্যাক্স হাসপাতালের সামনে ৭৬.৫ ডেসিবল মাত্রায় শব্দদূষণ পাওয়া যায়। একইভাবে বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল শব্দের মানমাত্রা থাকলেও নগরীর একে খান মোড়ে ৮৪.৫ ডেসিবল, জিইসি মোড়ে সর্বোচ্চ ৯৭.৫ ডেসিবল, বহদ্দারহাট মোড়ে ৮৪.৫ ডেসিবল, আগ্রাবাদ মোড়ে ৮৮ ডেসিবল, সিইপিজেড মোড়ে ৮৭.৫ ডেসিবল ও অঙিজেন মোড়ে ৭৭.৫ ডেসিবল মাত্রায় শব্দের তীব্রতা নির্ণয় করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চশব্দের প্রধান উৎস যানবাহনের অহেতুক হর্ন, ভবন নির্মাণের সামগ্রী, মাইক আর ইট গুঁড়া করার যন্ত্র। তবে সামাজিক অনুষ্ঠানে অতি উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। এতে প্রতিবেশীদের রাতের ঘুম হয় না, হৃদরোগীদের হৃৎকম্পন বেড়ে যায়, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মারাত্মক ক্ষতি হয়। মানুষের কর্মক্ষমতা কমছে, গর্ভবতী মা ও শিশুদের ওপর উচ্চশব্দের প্রভাব আরও মারাত্মক। শব্দদূষণ বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না। আইনকে তারা প্রয়োগ করতে চায় না।
বিধিমালা অনুযায়ী নীরব এলাকা যেমন হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, মসজিদ ও সরকার কর্তৃক ঘোষিত এলাকার সামনে দিনে ৫০ ডেসিবল মাত্রার বেশি শব্দ ছড়ানো যাবে না- এই মর্মে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বর্তমানে ওই সব স্থানে ৮০ ডেসিবলের উপরে শব্দের মাত্রা রয়েছে। এতে ব্যাপকভাবে শব্দদূষণ হয়। এ কারণে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ এলাকার সামনে দিনে ৫০ ডেসিবল মাত্রার বেশি শব্দ ছড়ানো যাবে না মর্মে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু কেউ কি শোনে এসব নিষেধাজ্ঞা! নগরীতে নিয়ন্ত্রহীনভাবে চলছে শব্দ দূষণ। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।